জীবনে নিইনি, মরণেও নেব না !

ফাইল ছবি।

‘একটি বাড়ি—একটি কবরস্থান’, এমন চরিত্র নিয়ে এ দেশে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামের বাসিন্দারা ‘গরিবের মধ্যে গরিব, ছোটলোকের মধ্যে আরও বেশি ছোটলোক’।

তাঁরা এতটাই ‘অস্পৃশ্য’ যে তাঁদের মরেও মুক্তি নেই। মারা যাওয়ার পর সামাজিক কবরস্থানে তাঁদের লাশের ঠাঁই হয় না। এখানকার বাসিন্দারা বাড়ি করার সময়, অর্থাৎ দু–এক কাঠা জায়গা কিনে সেখানে ঘর তোলার সময় তার পাশে কবরের জন্য জায়গা রেখে দেন। বাড়ির কেউ মারা গেলে সেখানে তাঁকে দাফন করা হয়।

এ গ্রামের বাসিন্দারা অপরাধী নন, তাঁরা গভীর রাতে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে নির্ভয় বিচরণের মধ্যে উদ্বেগময় উল্লাস অনুভব করা চোর-ডাকাতও নন। তাঁদের কেউ মাছ ধরেন, কেউ দিনমজুরি করেন, কেউ সাপ খেলা দেখান, কেউ মেলায় মেলায় চুড়ি–ফিতা বিক্রি করেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হালাল উপার্জন করে পেট চালানো এসব মানুষ মুসলমান হওয়ার পরও সামাজিক কবরস্থানে তাঁদের কবর দিতে দেওয়া হয় না। তাঁদের ‘অপরাধ’, তাঁরা বেদে ও সান্দার সম্প্রদায়ের মানুষ।

বিস্ময়কর গ্রামটির নাম ঝিটকা হাটবাসুদেবপুর। এটি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায় পড়েছে। প্রায় চার যুগ ধরে বেদে সম্প্রদায়ের ১৩০টি পরিবার বাস করে আসছে। বছর কুড়ি আগেও তাঁদের প্রধান পেশা ছিল তাবিজ-কবচ বিক্রি, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো, সাপ বিক্রি, শিঙা লাগানো, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, কবিরাজি, বানর খেলা, জাদু দেখানো ইত্যাদি। ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের এ যুগে সাপ খেলা আর চলে না। তাবিজ–কবচেও মানুষের বিশ্বাস কমেছে। ফলে বেশির ভাগ বেদেকেই আদি পেশা ছাড়তে হয়েছে। আদি পেশা ছাড়লেও তাঁদের ‘আদি পরিচিতি’ রয়ে গেছে। সেই পরিচিতি তাঁদের গায়ে একটা সোশ্যাল স্টিগমা সেঁটে দিয়েছে। তাঁরা সমাজের চোখে ‘জাত বেদে’।

‘ভদ্রলোকের’ কাছে বেদে, জেলে, ঋষি, বেহারা, নাপিত, ধোপা, হাজাম, কাওড়া, মেথর, ডোম—এ ধরনের জনগোষ্ঠীর অ্যান্টিক ভ্যালু আছে। তাদের অস্তিত্ব অনেকটা পুরাতাত্ত্বিক বিষয়ের মতো। গল্প, গান, গবেষণার অনুষঙ্গ হিসেবে এদের ব্যবহার করা হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একেকটি বেদে পরিবার ছোট্ট একেকটি ছইওয়ালা নৌকায় কী নিদারুণ কষ্টে কাটায়, ১০ ফুট বাই ৫ ফুটের ভাসমান জায়গায় কীভাবে একটি নবদম্পতি সংসার শুরু করেন, কীভাবে সেখানে শিশুর জন্ম হয়, কীভাবে তারা বেড়ে ওঠে, কী খায়, কেমন করে দিন কাটায়, তার দিকে রাষ্ট্রের নজর কতটুকু ছিল বা এখনো আছে, সে এক বিরাট প্রশ্ন।

সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের ‘অ্যান্টিক’ হিসেবে দেখে এসেছে। রাষ্ট্র তাঁদের ভাগ্য তাঁদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। ভদ্রসমাজ তাঁদের এ যাযাবরের জীবনকে পর্যটকের চোখে দেখে এসেছে। ফলে তাদের চোখে বেদেদের কষ্ট ধরা পড়েনি। কবি–শিল্পীরা তাঁদের যাযাবরের জীবনকে দর্শনীয় ও উপভোগ্য মনে করেছেন; তাঁরা বেদের জবানিতে লিখেছেন, ‘মোরা এক ঘাটেতে রান্দি–বাড়ি আরেক ঘাটে খাই/ মোদের সুখের সীমা নাই।’

বেদে পরিবারের একজন নারীর যে ন্যূনতম সম্ভ্রমবোধ থাকতে পারে, বাথরুম না থাকায় দিনের বেলায় প্রকাশ্যে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে গিয়ে তাঁকে যে অমানুষিক লজ্জায় পড়তে হতে পারে, তা শত বছরেও আমরা বিবেচনায় আনতে পারিনি। এ কারণেই তাঁদের এক ঘাটে রান্নাবাড়া করে আরেক ঘাটে খাওয়ার মধ্যে দুঃখের বদলে ‘সীমাহীন সুখ’ আবিষ্কার করি। তাঁদের গল্পে, কবিতায় আনা যায়, কিন্তু ভালোবেসে আপন করা যায় না। জীবনে তো নয়ই, এমনকি মরণেও নয়। এ কারণেই একই ধর্মের অনুসারী হওয়ার পরও নিজের কবরের পাশে একজন বেদে পরিবারের সদস্যের কবর হবে, এই একুশ শতকেও তা ‘ভদ্রলোকেরা’ মেনে নিতে পারেননি। সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, বেদে জনগোষ্ঠীর ৯৯ শতাংশ মুসলমান এবং ৯০ শতাংশ নিরক্ষর।

সমাজ ও রাষ্ট্র যদি এ বেদে সম্প্রদায়ের কষ্ট আমলে নিত, তাহলে কবরস্থানে তাদের দাফনে কেউ বাধা দিত না, ৯০ ভাগ লোক নিরক্ষর থাকত না। তবু কিছু আশাজাগানিয়া খবর আমাদের আন্দোলিত করে। সংবাদমাধ্যম থেকেই জানলাম, ঝিটকা হাটবাসুদেবপুর এলাকার বেদে ও সান্দার সম্প্রদায়ের লোকদের শেষ পর্যন্ত ‘শেষ ঠিকানা’ হয়েছে। সামাজিক কবরস্থানে বেদেদের কবর দিতে দেওয়া হয় না শুনে নিজের টাকায় ১৩ শতাংশ জমি কিনে তাঁদের জন্য কবরস্থান করে দিয়েছেন ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান। এটিকে সামাজিক স্বীকৃতির দিক থেকে এ জনজাতিকে এক ধাপ এগিয়ে নেওয়া বলা যেতে পারে। বেদে সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করা এবং তাদের জন্য নানামুখী সুযোগ করে দেওয়া এই পুলিশ কর্মকর্তার হাত ধরে ইতিমধ্যে সাভার ও মুন্সিগঞ্জের বেদেপল্লির জীবনচিত্র বদলে গেছে। সেখানে বেদে শিশুদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের নানা ধরনের পেশায় নিয়োজিত করার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেখানকার বেদেরা এখন নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। সমাজের মূলধারার সঙ্গে তাঁরা মিশে গেছেন।

কিন্তু সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় ২০ লাখ মানুষকে অশিক্ষা ও চরম অবজ্ঞাপূর্ণ জীবন থেকে বের করে আনার জন্য হাবিবুর রহমানের মতো একজন–দুজন মহান মানুষের ব্যক্তিপর্যায়ের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। বেদে ছাড়াও জেলে, ঋষি, বেহারা, নাপিত, ধোপা, হাজাম, কাওড়া, মেথর, ডোম—এই চির–অবহেলিত জনগোষ্ঠীগুলোকে অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের অন্ধকার থেকে বের করে আনতে সরকারকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে। এই মানুষগুলো যে আসলেই মানুষ, তাঁদেরও যে মান–সম্ভ্রম আছে, তাঁদেরও যে লিখতে–পড়তে পারার অধিকার আছে, মুসলমান হলে কবরস্থানে কবরস্থ হওয়ার এবং হিন্দু হলে শ্মশানে সৎকার পাওয়ার অধিকার আছে—জনমনে আগে এ মানবিক ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পাশাপাশি তাঁদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিশেষ প্রকল্প হাতে নিতে হবে। অর্থাৎ, তাঁদের অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমান গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক স্বীকৃতির দিকটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

পেছনে পড়ে থাকা এই মানুষগুলোকে নিচে ফেলে এগোতে গেলে অনিবার্যভাবে ‘সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে’। তাঁদের ‘পশ্চাতে’ রেখে এগোতে গেলে দেখা যাবে ‘সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’।

সারফুদ্দিন আহমেদ: সাংবাদিক ও লেখক

[email protected]