জীর্ণ-পুরাতন কবে ভেসে যাবে?

মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)। হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। এটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত থাকলেও পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় আকবরের আমল থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিনের সময় পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর বকেয়া খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন ভূ-স্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন, মেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। ক্রমান্বয়ে পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে সর্বজনীন এক মহোৎসব। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনেও পয়লা বৈশাখ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। তৎকালীন আইয়ুব সরকার ‘রবীন্দ্রচর্চা’র ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে, তার প্রতিবাদে বৈশাখের প্রথম দিনে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ঢাকার রমনা বটমূলে নববর্ষ পালনের আয়োজন করে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই অনুষ্ঠান ক্রমান্বয়ে বিপুল জনসমর্থন পেতে থাকে এবং স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির সংগ্রামের অংশ হয়ে ওঠে।
তারপর ক্রমে সাংস্কৃতিক উৎসবের সংখ্যা কমেছে, প্রতিক্রিয়াশীলতার চর্চা বেড়েছে। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবন থেকে উৎসারিত পয়লা বৈশাখ এখন নাগরিক উৎসবের ঝলমলে আয়োজন। কৃষকের জীবনের ‘হালখাতা’ খোলা হোক বা না হোক, শহুরে ব্যবসায়ীদের মুনাফার ঢোল বাজতে থাকে। নানা চটকদার বিজ্ঞাপনে বাজার ছেয়ে যায়। কোনো কোনো ফ্যাশন হাউস বলে, ‘এই শাড়ি/পাঞ্জাবি/অলংকার শুধু একটাই করা হয়েছে। এ কেবল আপনারই জন্য। দ্রুত অর্ডার করুন।’ আবার কেউ কেউ বিজ্ঞাপনে লিখেছেন, ‘প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ আমরা কারিগরদের দেব।’ কত অংশ দেবেন তা সুস্পষ্ট নয় যদিও, তবু ভাবখানা এমন যে এতে তাঁদের বদান্যতার সীমা নেই।
মাত্র কিছুদিন আগে, যখন পেট্রলবোমায় পুড়ে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছিলেন, বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন, সেই সব অগ্নিদগ্ধ আলোকচিত্র দিয়ে ঢাকার একটি বিখ্যাত ফ্যাশন হাউস নারী-পুরুষের পোশাক তৈরি করে বিক্রি করেছেন। মুনাফার লোভ কতটা লকলকে হয়ে উঠলে এ ধরনের কাজ করা যায়!
তবু চাই, উৎসব হোক। এত আত্মবলিদানের এই দেশে চারদিক যখন অন্ধকারে ঢেকে যায়, তখন খুব ইচ্ছে করে নব আনন্দে জাগতে। প্রতিক্রিয়ার শক্তির অভয়ারণ্য যখন চারপাশ, তখন একটি দীর্ঘ মঙ্গল শোভাযাত্রা অশুভের বিনাশের দিকে ধাবিত হোক। রাজনীতিতে হিংস্র কপটতা, সংস্কৃতিতে আপস, পরিবার ও ব্যক্তিমানসে চূড়ান্ত নৈরাজ্য—সবকিছু প্রবল বাতাসে উড়িয়ে, দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে বজ্র-বিদ্যুৎ নিয়ে বৈশাখী ঝড় আসুক, বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক, জীর্ণ-পুরাতন যাক ভেসে যাক। নববর্ষের নব আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সব প্রাণে।
কিন্তু, সব সময় জয় হয় না চাইলেই। একদা যা ছিল মূল্যবোধের প্রতীক, এখন তা উপহাসের ফিসফাস। এখানে রাষ্ট্রের সম্পদ চুরি করে যারা, তারা বুক চিতিয়ে হাঁটে, কখনো কখনো জনপ্রতিনিধিও হয়। চুরি সমাজে আছে, প্রতিকারহীনতাও আছে, সুতরাং চুরির অভ্যাসও আছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের এক তরুণ কূটনীতিক নেদারল্যান্ডসের একটি ইলেকট্রনিক দোকান থেকে চুরি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন। তিনি স্বীকার করে বলেছেন, তাঁর কয়েকজন সহকর্মী এর আগে এ ধরনের কাজ করেছেন এবং তাঁরা কেউই ধরা পড়েননি। তাতেই তিনি উৎসাহিত হয়েছেন। ওই কূটনীতিক ও তাঁর নয়জন সহকর্মী ডাচ সরকারের খরচে ও তাদের আমন্ত্রণে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিতে নেদারল্যান্ডসে যান। ৩৫০ ইউরো জরিমানা দিয়ে ওই কূটনীতিক রেহাই পেলেও ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত ডাচ সরকার বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছে।
মানুষের মানুষ হিসেবে বেঁচেবর্তে থাকার লড়াইটা এখন বৈশ্বিক। দুই মাসের কাছাকাছি সময় হলো কানাডার মন্ট্রিয়লে এসেছি। অভিবাসী বাঙালিদের আয়োজিত কয়েকটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে এসেছি এখানে। আমার স্ত্রী, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোকেয়া চৌধুরীর সঙ্গে এখানে যে বাসায় থাকছি, ৩১ মার্চ রাতে আকাশে ওড়া হেলিকপ্টারের শব্দে সেই ঘরে টেকা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, ঘরের ছাদেই হেলিকপ্টার নেমেছে। পরদিন অনলাইনে সংবাদ দেখে কারণটা বোঝা গেল। শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করছিল সেই রাতে। তাদের দিকে সন্ধানী আলো ফেলে আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল পুলিশের হেলিকপ্টার। ২ এপ্রিল সেই বিক্ষোভ পুরো মন্ট্রিয়ল শহরকে অচল করে দিল। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিলে নামল মাঝারি আয়ের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। পরদিন মন্ট্রিয়ল গেজেট-এ লেখা হলো, বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল ১ লাখ ২ হাজারেরও বেশি মানুষ। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সেই বিক্ষোভ মিছিল দেখেছি। কুইবেক প্রদেশের মেয়রের বিশাল বিশাল সব ব্যঙ্গাত্মক মুখোশ, রংবেরঙের প্ল্যাকার্ড আর হরেক রকমের প্যারেড সংগীত। এক দলের বাজানো সুরে উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম। খুব পরিচিত সুর। কোন গান এটা? হঠাৎ শিহরিত হলাম: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সোভিয়েত রেড আর্মি যখন ফ্যাসিস্ট হিটলার বাহিনীকে হটাচ্ছে পেছনের দিকে, তখনকার একটি গান, বাংলা অনুবাদ করে গেয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস: ‘ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার ও তুফান/ প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল/ কমরেড লেনিনের আহ্বান/ চলে মুক্তি সেনাদল...।’
চারুকলা অনুষদ থেকে এবার যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হবে পয়লা বৈশাখের সকালে, কৃষকের জমি ও অধিকার কেড়ে নেওয়া জোতদার এবং জোতদারি রাষ্ট্রের একটা মুখোশ কি সেখানে থাকবে? ঐতিহ্যের নামে এসব জীর্ণ-পুরাতন আর কত? অনেক তো হলো!
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]