জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তি কত দূরে?

জাতিসংঘ গ্রুপের প্রতিবেদন হাতে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসের ব্যালকনিতে অ্যাসাঞ্জ
জাতিসংঘ গ্রুপের প্রতিবেদন হাতে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসের ব্যালকনিতে অ্যাসাঞ্জ

উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০১০ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন, তা এককথায় নিদারুণ বন্দিদশা। গোপন তথ্য প্রকাশের দায়ে কোনো প্রকাশকের ওপর বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত দমন-পীড়নের এত দীর্ঘ ইতিহাস বিরল। উইকিলিকস ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অ্যাসাঞ্জের গোপনীয়তাবিরোধী তৎপরতা বিশ্বজুড়ে বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছে; তাঁর ও উইকিলিকসের প্রতি বিশ্বের নাগরিক সমাজের নৈতিক ও আর্থিক সমর্থন প্রবল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইডেনসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর শাসকেরা তাঁকে প্রবল শত্রু বলে গণ্য করেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাঁকে গুপ্তচরবৃত্তিসংক্রান্ত আইনে অভিযুক্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সুইডেন ও যুক্তরাজ্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মার্কিন সরকার অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে বিচারের নামে ‘হত্যা’ করতে চায়—এটা অ্যাসাঞ্জের আশঙ্কা। তাঁর সমর্থকেরাও মনে করেন যে এই আশঙ্কার যথেষ্ট ভিত্তি আছে।
এসব পুরোনো খবর। নতুন খবর হচ্ছে, জাতিসংঘের মানবাধিকারসংক্রান্ত হাইকমিশনের দপ্তরের অধীনস্থ ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন’ (ডব্লিউজিএডি) ৫ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেছে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের বন্দিদশা বেআইনি। জাতিসংঘের এই গ্রুপটি অ্যাসাঞ্জকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে এবং বলেছে, যুক্তরাজ্য ও সুইডেন সরকারের উচিত অ্যাসাঞ্জকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
স্মরণ করা যেতে পারে, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০১২ সালের ১৯ জুন থেকে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আটকা পড়ে আছেন। সুইডিশ কর্তৃপক্ষের দায়ের করা প্রত্যর্পণ মামলায় তাঁর পরাজয় আসন্ন, সেই মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে গ্রেপ্তার করে সুইডেনে পাঠিয়ে দেবে—এটা বুঝতে পেরে অ্যাসাঞ্জ ওই তারিখে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে ঢুকে দেশটির সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ইকুয়েডর তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে এবং তাঁকে লন্ডন থেকে ইকুয়েডরে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে, অ্যাসাঞ্জ লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসের বাইরে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গ্রেপ্তার করে সুইডেনে প্রত্যর্পণ করা হবে। সেই থেকে গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে অ্যাসাঞ্জ ওই দূতাবাসের ভেতরেই বন্দিজীবন যাপন করছেন। ইতিমধ্যে তাঁর স্বাস্থ্যের অনেক অবনতি হয়েছে, কিন্তু ওই দূতাবাসের বাইরে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে দেয়নি। ইকুয়েডর সরকারের সব রকমের কূটনৈতিক দেনদরবার বিফলে গেছে; ব্রিটিশ সরকার ওই দূতাবাসের চারপাশে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরার পেছনে ব্যয় করেছে ১২ মিলিয়ন পাউন্ড।
জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন বলেছে, অ্যাসাঞ্জের ইকুয়েডর দূতাবাসের আটকাবস্থাই শুধু ‘আরটিট্রারি ডিটেনশন’ বা আইনবহির্ভূত আটকাবস্থা নয়, বরং ২০১০ সালে লন্ডনে প্রথম যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন থেকে এ পর্যন্ত পুরোটা সময় ধরেই তাঁর স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। আমরা জানি, অ্যাসাঞ্জ একাধিকবার সুইডিশ প্রসিকিউশনকে অনুরোধ জানিয়েছেন, তারা যেন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বা ইকুয়েডর দূতাবাসে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু সুইডিশ প্রসিকিউশন সেটা করতে সম্মত হয়নি। তারা অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অবস্থানে অনড় রয়েছে। জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ এ জন্য সুইডিশ প্রসিকিউশনের সমালোচনা করে বলেছে যে অ্যাসাঞ্জ তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা সত্ত্বেও তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করেনি।
সুইডেনে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে দুই নারীকে ধর্ষণ ও তাঁদের সঙ্গে যৌন অসদাচরণের অভিযোগে মামলা হয়েছে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জোরালো অভিমত আছে যে এসব মামলা করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায়। কারণ, অ্যাসাঞ্জ উইকিলিকস ওয়েবসাইটে আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধ সম্পর্কে বিপুল পরিমাণ গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন এবং আড়াই লাখের বেশি মার্কিন কূটনৈতিক তারবার্তার এক বিশাল ভান্ডার কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের হাতে তুলে দিয়েছেন। অ্যাসাঞ্জের যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়ার এটাই আদি ও মূল কারণ। কিন্তু সুইডিশ প্রসিকিউশন পাঁচ বছরেও অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগপত্র দাঁড় করাতে পারেনি। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ সুইডিশ আইন অনুযায়ীই তামাদি হয়ে গেছে, রয়েছে শুধু ধর্ষণের অভিযোগ। কিন্তু আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র ছাড়াই অ্যাসাঞ্জ বিনা বিচারে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বন্দিজীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা তাঁর মানবাধিকারের বিরাট লঙ্ঘন—জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের মূল বক্তব্য এটাই।
এরপর অ্যাসাঞ্জের ভক্ত-সমর্থকদের মধ্যে তাঁর বন্দিদশা অবসানের একটা ক্ষীণ আশা জেগেছিল। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই আশার আলো নিভে গেছে, কারণ যুক্তরাজ্য ও সুইডেন সরকার জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুেপর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তো তাদের প্রতিবেদনকে ‘রিডিকুলাস’ বা হাস্যকর বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, অ্যাসাঞ্জকে কেউ আটক করে রাখেনি, বরং তিনি নিজেই ইকুয়েডর দূতাবাসে নিজেকে আটকে রেখে ‘নাটক’ করছেন। তিনি আরও বলেছেন, অ্যাসাঞ্জের উচিত ইকুয়েডর দূতাবাস থেকে বেরিয়ে এসে সুইডিশ প্রসিকিউশনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, অর্থাৎ গ্রেপ্তার বরণ করা।
কিন্তু জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নির্বোধ নন। ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর সকালে লন্ডন পুলিশের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি এক থানায় গিয়ে সশরীরে হাজির হয়েছিলেন তাদের ‘কিছু প্রশ্নে’র জবাব দিতে। কিন্তু লন্ডন পুলিশ তাঁকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে গ্রেপ্তার করেছিল এবং একটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করেছিল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব লোক দেখানো কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর অ্যাসাঞ্জকে সোজা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কারাগারে। অ্যাসাঞ্জ তখন নিজের নির্বুদ্ধিতা ধরতে পেরেছিলেন: লন্ডনের পুলিশ ও বিচারব্যবস্থাকে তিনি যতটা সভ্য মনে করেছিলেন, তারা যে ততটা সভ্য নয়, সেটা বুঝতে তাঁর আর দেরি হয়নি। একই সঙ্গে তাঁর এ বিশ্বাস আরও জোরালো হয়েছিল যে এসব কিছুর কলকাঠি নাড়ছে মার্কিন প্রশাসন। যেকোনো উপায়ে তারা তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে চায়, আর সেটা ঘটলে তাঁকে যে অকালে প্রাণ হারাতে হবে—এটাও অ্যাসাঞ্জ বেশ ভালোভাবেই জানেন।
জাতিসংঘের গ্রুপটির প্রতিবেদন প্রকাশের খবর যেদিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেদিন বিকেলে অ্যাসাঞ্জ লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতিবেদনটির একটা কপি হাতে নিয়ে। তাঁর অনেক সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন নিচে। অ্যাসাঞ্জ আনন্দ প্রকাশ করে তাঁদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এটা একটা মধুর বিজয়। ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বিজয়। ওরা হেরে গেছে, যুক্তরাজ্য হেরে গেছে! সুইডেন হেরে গেছে!’ তাঁর ভক্তরা চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘আমরা তোমাকে ভালোবাসি, জুলিয়ান!’
যদিও জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপটির বক্তব্যে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের অবস্থার কোনো পরিবর্তন আপাতত আশা করা যাচ্ছে না, তবু এটা তাঁর আইনজীবী দলের জন্য একটা বিরাট শক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। গ্রুপটি একতরফাভাবে নিজেদের ইচ্ছামাফিক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি; তারা অ্যাসাঞ্জের ব্যাপারে প্রতিবেদন তৈরি করার আগে ব্রিটিশ ও সুইডিশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য চেয়েছিল, দেশ দুটি তাদের বক্তব্য পাঠিয়েছিলও। সবকিছু খতিয়ে দেখার পরেই গ্রুপটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে অ্যাসাঞ্জের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তাঁর বন্দিদশার অবসান ঘটানো উচিত।
কিন্তু যুক্তরাজ্য ও সুইডেন যখন জাতিসংঘ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করল, তখন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সামনে আর কী উপায় রইল? আর কত মাস, কত বছর তাঁকে ওই দূতাবাসের ভেতরেই বন্দিদশায় কাটাতে হবে? তাঁর আইনজীবীরা বলছেন, তাঁরা সুইডিশ কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত লিখে জানতে চাইবেন, তারা জাতিসংঘ ওয়ার্কিং গ্রুপের ‘ফাইন্ডিংস’ কীভাবে ‘এনফোর্স’ বা ‘অ্যাপ্লাই’ করবে। অ্যাসাঞ্জ আবারও স্ট্রাসবুর্গের ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। অবশ্য এই আদালত ইতিমধ্যে একবার অ্যাসাঞ্জের আবেদন ‘ইনঅ্যাডমিসেবল’ বা অগ্রহণযোগ্য বলে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
অ্যাসাঞ্জ হয়তো শেষ পর্যন্ত ইউএন ‘কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার’ বা জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের বলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টে যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারেন। এ রকম আভাস তিনি সেদিন ওই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দিয়েছেন: ‘যদি এই বেআইনি ও অনৈতিক আটকাবস্থা অব্যাহত থাকে, তাহলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে ‘ক্রিমিনাল কনসিকোয়েন্সেসের’ মুখোমুখি হতে হবে।’
মশিউল আলম: লেখক ও সাংবাদিক৷
[email protected]