জেদ ছেড়ে বাস্তবতায় ফিরে আসুন

দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ পোড়ানো, গাড়িতে আগুন দেওয়াসহ বিভিন্ন নাশকতা-নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ পোড়ানো, গাড়িতে আগুন দেওয়াসহ বিভিন্ন নাশকতা-নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।

‘দুটি বড় দলের কাছে বাংলাদেশ জিম্মি হয়ে আছে।’ বহুবার বলা হলেও এ কথাটির ধার কমেনি। এ জন্য জনগণ শুধু হতাশাই প্রকাশ করছে। এ দুটি দল যে নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, তা জনগণ দেখেও না দেখার ভান করছে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। জনগণই দেশের মালিক। তাদের ভোট পেলেই এসব স্বৈরাচারী রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যায়। কাজেই আজ যদি বড় দল দুটি অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, তার জন্য জনগণের দায়ও কম নয়। আমরাই তো এ ধরনের নেতৃত্বকে ক্ষমতায় বসিয়েছি বা বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় বসিয়ে থাকি। আমরা ভোটাররা এ জন্য দায়ী। অন্যকে দোষারোপ করার আগে আমাদের নিজের দোষটিও দেখতে হবে।
দেশে এখন বিরাট রাজনৈতিক সংকট চলছে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও মানুষ মারা যাচ্ছে। ট্রেন, লঞ্চ, দূরপাল্লার বাস, প্রাইভেট গাড়ি, অন্যান্য যানবাহন প্রায় কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারছে না। অবরোধ, হরতাল, চোরাগোপ্তা হামলা, গাড়িতে আগুন, ট্রেনের লাইন উপড়ে ফেলা ইত্যাদি নানা গণতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। বর্তমান আন্দোলন ও রাজনীতির সামনে দুটি ইস্যু। সরকার বলছে, তারা পাঁচ বছরের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছে। তাই ২০১৯-এর আগে নির্বাচন নয়। বিএনপির নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোট ও আরও কয়েকটি দল বলেছে, ৫ জানুয়ারি কোনো স্বাভাবিক নির্বাচন হয়নি। শুধু সংবিধান রক্ষার নির্বাচন হয়েছে। কাজেই এখন সব দলের অংশগ্রহণে নতুন নির্বাচন হতে হবে।
এই নির্বাচনের দাবি নিয়েই যত আন্দোলন, প্রাণহানি ও মানুষের স্বাভাবিক জীবনে বিড়ম্বনা।
সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘সংবিধান রক্ষার নির্বাচন’ (যা তারা আগে বলেছে) হিসেবে মেনে নিলেই কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্তু সরকার জেদ করছে। তারা এখন আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ২০-দলীয় জোটের এই দাবি কোনো অন্যায় দাবি নয়। দেশবাসী সবাই দেখেছে, ৫ জানুয়ারি কোনো স্বাভাবিক নির্বাচন হয়নি। স্বাভাবিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে নিশ্চয়ই বিএনপি নতুন নির্বাচনের দাবি তুলতে পারত না। দাবি তুললেও তা জনসমর্থন পেত না। যেকোনো দেশে সংসদ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হয়। কাজেই সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো ফাঁকি বা প্রতারণা কেউ মেনে নেবে না। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল। কাজেই আওয়ামী লীগ যতই জেদ করুক, যতই নানা বাহিনীকে দিয়ে দমন-পীড়ন চালাক, বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নেবে না। দমন-পীড়ন দিয়ে কোনো আন্দোলন স্তব্ধ করা যায় না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাঁদের দলের ইতিহাস পড়লেই তা জানতে পারবেন। কাজেই সরকার নির্বাচনের দাবি যত দ্রুত মেনে নেবে, ততই তাদের জন্য মঙ্গল। আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে তাতে লাভ হবে বিএনপির। সরকার জনপ্রিয়তা হারাবে।
সরকারের একটি গ্রুপ হয়তো মনে করছে, এখন নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগ জিততে পারবে না। বিএনপি জিতে গেলে দেশে তারা একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ফেলবে। আমাদের মনে হয়, এই ধারণা ঠিক নয়। প্রথমত, আওয়ামী লীগ সরকার অনেক উন্নয়ন করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে, শাস্তি দিতে পেরেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছে। অনেক ভোটারের কাছে এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই নতুন করে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ জিততে পারে। তবে গত ছয় বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসনের বহু নজিরও রয়েছে। আওয়ামী লীগ যদি এ জন্য ভীত হয় তাহলে ভিন্ন কথা। তবে অনেকের ধারণা, শুধু ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ কার্ডটি দিয়ে আওয়ামী লীগ আবার জিততে পারে।
আবার বিএনপি জোট সরকার গঠন করতে পারলে দেশে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যাবে, এই ধারণাও ঠিক নয়। কেননা হাওয়া ভবনসহ বিএনপির অপশাসনের নানা স্মৃতিও মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। তারেক রহমান নিয়েও বিএনপির বহু সমর্থকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপির জামায়াতঘেঁষা রাজনীতিও অনেকের না-পছন্দ। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি নতুন কী করবে, সে ব্যাপারেও দলটি কখনো আভাস দেয়নি। কাজেই নির্বাচন হলেই বিএনপি জয়লাভ করবে, এতটা নিশ্চিত হওয়ার কিছু নেই। বিএনপির একমাত্র পুঁজি আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন। নেতিবাচক ভোটেই দলটির জয়ের বড় সম্ভাবনা অনেকে দেখছেন।
সরকার নির্বাচন দিতে রাজি হলেও সমস্যার পুরো সমাধান হবে না। তারপর যে প্রশ্নটি আসবে, তা হলো নির্বাচন পরিচালনার সরকার। বিএনপি বলেছে, তারা ‘দলীয় সরকারের’ অধীনে নির্বাচনে যাবে না। আবার সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধানটিও নেই। বিএনপি এখন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবিতে অনড় থাকলে তা যুক্তিহীন হবে। আমরা মনে করি, সরকার, সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ আলাপ-আলোচনা করে একটা মোটামুটি ‘ক্ষমতাহীন’ দলীয় সরকার ও পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করা যায়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের আগে তিন মাস প্রকৃত ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এভাবে যদি নতুন নির্বাচন সফল হয়, তাহলে এটাই পরবর্তীকালে মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আমাদের বিশ্বাস, সব রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকারের একটা সর্বসম্মত মডেল বের করতে পারবে; যা সংবিধানবহির্ভূতও হবে না।
কিন্তু নির্বাচনই শেষ কথা নয়। নির্বাচিত সরকার তার যেসব ‘বাহু’ দিয়ে অপশাসন প্রতিষ্ঠা করে সেই সব ‘বাহু’ কেড়ে নিতে হবে নির্বাচনের আগেই। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কাছে অঙ্গীকারপত্রে সই করতে হবে প্রতিটি দলকে। ‘নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের করণীয়’ সম্পর্কে বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোতে বিস্তারিত লিখেছেন (১৪ জানুয়ারি)। এখানে পুনরাবৃত্তি করছি না। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ এখনই আলোচনা শুরু করতে পারে। নাগরিক সনদ নিয়ে বিভিন্ন মতকে স্বাগত জানানো উচিত। এ রকম একটি নাগরিক সনদে স্বাক্ষর না করে কোনো রাজনৈতিক দলকেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ, রাজনৈতিক দলের আসল চেহারা দেখা যায় নির্বাচিত হওয়ার পর। আমরা এমন একটি গণতন্ত্র ও জাতীয় সংসদ তৈরি করেছি, যেখানে নির্বাচনে ১৫১টি সিট পেলেই পাঁচ বছরের জন্য সেই দল দেশের একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক হয়ে যায়। তারা যা খুশি তা করতে পারে। সংসদের বিরোধী দলকেও তারা গ্রাহ্য করে না। দলের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করে। যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে সবাই নিরপেক্ষতার প্রতীক মনে করে, বিজয়ী দল বা সরকার সে রকম প্রতিষ্ঠানকেও পকেটে ঢুকিয়ে ফেলতে পারে। সরকারের এত ক্ষমতা! নির্বাচিত সরকারের কত ‘ক্ষমতা’, তা আওয়ামী লীগের গত ছয় বছরের শাসনকাল পর্যালোচনা করলেই অনুধাবন করা যাবে। কাজেই এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচনের আগেই ‘জাতীয় সনদ’ ধরনের কিছুতে সব দলকে স্বাক্ষর করা খুবই জরুরি। আগেই বলেছি, দুটি বড় দল শুধু নির্বাচনে আগ্রহী; অন্য কিছুতে নয়। অঙ্গীকার ছাড়া নির্বাচিত হলে আমাদের আবার অপশাসনের গর্তে পড়তে হতে পারে।
আমরা এমন একটি সংবিধান রচনা করেছি, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর অগাধ ক্ষমতা। ড. আকবর আলি খানের মতে, আমাদের ‘প্রধানমন্ত্রী’ মোগল বাদশাহদের চাইতেও ক্ষমতাবান। এ ব্যাপারেও সব দলের চিন্তাভাবনা করা উচিত। বিভিন্ন দল সংসদীয় গণতন্ত্রের নামে ‘এক ব্যক্তির শাসন’ চায়, না সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত শর্তে সমষ্টিগত শাসন চায়, তা তাদেরই ঠিক করতে হবে। এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জোর দাবি ওঠা উচিত। আমাদের দেশে এখন যে রাজনৈতিক সংকট চলছে, তা মূলত ব্যক্তির শাসনের পরিণাম। বর্তমানে একটি বড় দল বা নামকাওয়াস্তে ১৪-দলীয় জোটের সরকার হলেও সরকার মূলত পরিচালিত হচ্ছে ব্যক্তি দ্বারা। এটা গণতন্ত্রের জন্য মোটেও শুভ নয়।
দেশের মানুষ এই চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি চায়। এ জন্য কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলো ১. বিরোধী দলকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে দেওয়া, ২. সব রকম দমন-নিপীড়ন, গ্রেপ্তার বন্ধ করা ও রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেওয়া, ৩. দেশের সবখানে হিংসাত্মক ঘটনা অবিলম্বে বন্ধ করা, হরতাল, অবরোধ প্রত্যাহার করা, ৪. দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সব দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা।
সরকার যদি তাদের জেদের বশে পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে চায়, তাহলে দেশের পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।