জোড়া চাপে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

না, এমনটা ভাবেননি তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালের মে মাসে ৩৪ বছরের বাম জমানাকে ধুলোয় মিশিয়ে ক্ষমতায় আসার পর তিনি অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর চোখমুখে ছিল দারুণ স্বপ্ন। বামফ্রন্ট শাসন করেছিল ৩৪ বছর। মমতার স্বপ্ন আরও বেশি দিনের। তিনি মনে করেছেন, এখনো গ্রামাঞ্চলে তাঁর দলের দুর্গ অটুট। তাই সব সভা-সমাবেশে তাঁর নেতা-মন্ত্রীরা বলেছিলেন, ৩০ বছরেও মমতাকে সরাতে পারবে না বিরোধীরা। বামফ্রন্ট তো এখন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। এসব স্বপ্ন আঁকড়ে ধরেই মমতা রাজ্য শাসনে ব্রতী হন। গত এপ্রিল-মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় ভারতের লোকসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচন ঘিরে মমতা ও তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের চোখে ভাসে নতুন করে স্বপ্ন। মমতার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন। দলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সমাবেশে সে কথা বলতেও দ্বিধা করেননি।
মমতার যুক্তি ছিল, লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট (ইউপিএ) বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএ) কেউই শাসনক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। ছোট ছোট আঞ্চলিক দলের জোটই হবে সরকার গঠনের মূল শক্তি। আর সে ক্ষেত্রে তাঁর দল হবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। নির্ণায়ক শক্তি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের দরাদরিতে সেই সুযোগ এসেও যেতে পারে মমতার। এই স্বপ্নে বিভোর মমতা লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নেমে বিভিন্ন জনসভায় বিজেপি ও তার প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদিকে ছাড়েননি। তাঁকে কোমরে দড়ি দেওয়ার হুমকি দিতেও কুণ্ঠা বোধ করেননি।
অথচ নির্বাচনের ফলাফল মমতার সব স্বপ্ন উল্টে দেয়। বিজেপি এককভাবে ক্ষমতায় আসেন। নরেন্দ্র মোদিই প্রধানমন্ত্রী হন। প্রথম রাজনৈতিক ধাক্কা খান মমতা। দ্বিতীয় ধাক্কা খান লোকসভা নির্বাচনের পশ্চিমবঙ্গের ফলাফলে। যে বিজেপি এই রাজ্যে প্রায় শূন্যের ঘরে ছিল, সেই বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে! মমতা তৃতীয় ধাক্কা খান সারদা কেলেঙ্কারি ইস্যুতে। পশ্চিমবঙ্গের এযাবৎ সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি এই সারদাগোষ্ঠীর ২২ হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারি। ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তুলে নিয়েছিল তারা।
গত বছরের এপ্রিল মাসে এই সারদা কেলেঙ্কারির কথা প্রথম ফাঁস হয়। গত ৬ এপ্রিল সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইকে তাঁর পতনের কাহিনি নিয়ে ১৮ পাতার একটি চিঠিতে ২২ ব্যক্তির নাম লিখে চার দিন পর পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে যান। ওই চিঠিতেই তিনি উল্লেখ করেন মমতার দলের কয়েকজন মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক তাঁকে কীভাবে প্রতারিত করে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেছেন। সুদীপ্ত সেন পালিয়ে আশ্রয় নেন জম্মু ও কাশ্মীরের একটি হোটেলে। সেখান থেকেই তিনি গ্রেপ্তার হন এপ্রিলের শেষে তাঁর দুই সহকর্মীসহ। তিনি এখনো কারাগারে।
এই ঘটনার পর মমতার সামনে নতুন করে আরেক বিপদ হাতছানি দেয়: সারদা বিপদ। তাই সারদার তদন্ত যেভাবেই হোক তার পুলিশ বাহিনী দিয়ে করাতে হবে। এই তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে চলে গেলে আর রক্ষা নেই। সুতরাং মমতা উদ্যোগ নেন সারদাকাণ্ড রাজ্যের সিআইডি পুলিশ দিয়ে তদন্ত করানোর। গঠনও করেন একটি বিশেষ তদন্ত দল। পাশাপাশি মমতা সারদার কাছ থেকে প্রতারিত সাড়ে ১৭ লাখ আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য গঠন করেন বিচারপতি শ্যামল সেন কমিশন। কমিশনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে মমতা সারদা আন্দোলন স্তিমিত করার উদ্যোগ নেন।
কিন্তু নাছোড়বান্দা আমানতকারীরা। তাঁরা রাজ্যব্যাপী ছড়িয়ে দেন এই আন্দোলন। সারদাকাণ্ড সিবিআইয়ের মাধ্যমে তদন্ত করানোর দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে একাধিক জনস্বার্থ মামলা হয়। কিন্তু রাজ্য সরকারের আপত্তিতে সেখান থেকে সুফল না পেলে এই মামলা শেষ পর্যন্ত ওঠে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট গত মে মাসে নির্দেশ দেন সারদার তদন্ত করবে সিবিআই। চতুর্থ ধাক্কা খান মমতা।
এখন এই সারদা মামলার তদন্ত করছে সিবিআই। সিবিআই ইতিমধ্যে জেরা শুরু করেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও নেতাকে, যাঁদের বিরুদ্ধে উঠেছে এই কেলেঙ্কারির অভিযোগ। গ্রেপ্তারও করেছে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে। সিবিআইয়ের পাশাপাশি সারদাকাণ্ড পৃথকভাবে তদন্ত করছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আরেকটি সংস্থা ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট। সেখানেও ইতিমধ্যে জেরা করা হয়েছে বলিউড তারকা ও তৃণমূল সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তী, আরেক সাংসদ মহম্মদ ইমরানকে।
ফলে সারদাকাণ্ডে সিবিআই তদন্ত নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। উঠে আসছে এই কেলেঙ্কারিতে তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কদের নাম। ফলে একদিকে বিজেপির উত্থান আর অন্যদিকে সারদাকাণ্ড—এই দুই চাপে মমতা আজ চরম অস্বস্তিতে। আর এই দুই চাপ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মমতা বাম দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বাম দল মমতার ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। কারণ, যে মমতা এখনো প্রতিদিন বাম দলকে গালাগালি না করে মুখে অন্ন নেন না, সেই মমতার সুর বদলে গেলেও বাম দলগুলোর মন গলেনি তাতে।
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপি কোমর বেঁধে নামার প্রস্তুতি নিয়েছে। মমতার আশঙ্কা, বিজেপির এই উত্থান এবং সারদার চাপে শেষ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটে না যায়। সে রকম কিছু যাতে না ঘটে সে জন্য তিনি মরিয়া হয়ে মিতালির হাত বাড়িয়েছিলেন বাম দলের দিকে। কিন্তু তাতে কোনো সুফল ফলল না। আর জাতীয় কংগ্রেস তো আগে থেকেই মমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছে। ফলে মমতাকে এখন বিজেপির উত্থান এবং সারদার ভূত ভীষণভাবেই তাড়া করে ফিরছে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।