জো বাইডেনের এ বিজয়ের বার্তা কী

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ছবি: রয়টার্স

জো বাইডেন এক ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁর রানিং মেট ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের বিজয় একাধিক কারণেই অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয়। এ বিজয়ের বিভিন্ন মাত্রা নিয়ে এখন গণমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। মহামারি ও অর্থনৈতিক সংকটের বিরূপ পরিবেশের মধ্যেও অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে মার্কিন নাগরিকেরা ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে যে রায় দিয়েছেন, তাকে মার্কিন রাজনীতির বিভিন্ন ধারার প্রেক্ষাপটে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? এ বিজয়ের বার্তা কী? এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মার্কিন শাসনকাঠামোর প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে?

এ নির্বাচনের ফল নিয়ে সংশয় না থাকলেও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া কতটা অতীতের মতো প্রচলিতভাবে হবে, তা নিয়ে সংশয় কাটছে না। কেননা, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ও বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো পরাজয় স্বীকার করেননি। বরং তিনি টুইট করে যাচ্ছেন যে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর প্রচারশিবিরের আইনজীবীরা বিভিন্ন রাজ্যে মামলা করছেন, চেষ্টা করছেন কী করে ভোট গণনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া যায়। তাঁদের প্রত্যাশা, আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল বিচারকেরা তাঁদের জন্য এগিয়ে আসবেন। এ শুধু তাঁদের প্রত্যাশাই নয়, এ কথা তাঁরা সরবে বলেছেনও। ৫ নভেম্বর ফক্স বিজনেস নেটওয়ার্ক টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে লইয়ার্স ফর ট্রাম্প কোয়ালিশন নামের একটি নতুন সংগঠনের যুগ্ম প্রধান হারমিট ডিলন সরাসরি আদালতের উদ্দেশেই বলেছেন তাঁরা অপেক্ষা করছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা কখন হস্তক্ষেপ করবেন এবং কিছু করবেন; তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে আদালতের তিনজন বিচারপতিকে ট্রাম্প নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি বিশেষভাবে নতুন বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটের কথা উল্লেখ করেছেন। উদ্বেগজনক এসব কথাবার্তা সত্ত্বেও আশার বিষয় এখন পর্যন্ত এ ধরনের পরিস্থিতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তদুপরি আইনিভাবে সুপ্রিম কোর্টের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারার মতো কিছুই ট্রাম্পের পক্ষ থেকে হাজির করা সম্ভব হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা নিয়ে একধরনের সংশয় ছিল, তা শিগগিরই সম্পূর্ণ অবসিত হবে তা মনে হচ্ছে না।

রাষ্ট্রের এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে ভাবনা ও উদ্বেগ থাকলেও যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই তা হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থাটি শক্তিশালীভাবেই টিকে আছে। প্রাথমিক হিসাবে কমপক্ষে ১৬১ মিলিয়ন মানুষ ভোট দিয়েছেন, যা মোট ভোট দিতে পারতেন, এমন মানুষের ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এবার আগাম ভোট হয়েছে সবচেয়ে বেশি, মানুষ ডাকযোগে ভোট দিয়েছেন, সাময়িক ব্যালটে ভোট দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কেন্দ্রীয় নির্বাচনী ব্যবস্থা নেই রাজ্যে রাজ্যে বিকেন্দ্রীকৃত, ভিন্ন ভিন্ন ধরনের নিয়মকানুন সত্ত্বেও নির্বাচনী ব্যবস্থা যে কেবল অটুট আছে তা-ই নয়, মানুষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচনের ওপর আস্থা রেখেছে। রেখেছে এমন এক সময়ে, যখন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন মাসের পর মাস। যখন এ আশঙ্কা ছিল যে নির্বাচনের আগে ও নির্বাচনের দিন সহিংসতা হতে পারে। গত গ্রীষ্মকাল থেকে দেশে পুলিশি নিপীড়নের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানের ওপর এক বিশাল অংশের এ আস্থা লক্ষণীয়। গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ট্রাম্পের উত্থানের পর, মার্কিন গণতন্ত্রের বড় রকমের ক্ষয় হয়েছে, গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রান্ত হয়েছে; কিন্তু গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান যে এখনো শক্তিশালী আছে এবং তা যে এখনো নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে, সেটা ইতিবাচক তো অবশ্যই, সেটা এ শাসনব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির প্রমাণও বটে। নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, কিন্তু সবার অংশগ্রহণের নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না।

অবশ্যই এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়ে যায়নি এ অর্থে যে ক্ষমতা হস্তান্তর এখনো হয়নি—সে জন্য ভূমিকা আছে আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের; আগামী দিনগুলোতে সেসব প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা বাকি আছে। গত কয়েক বছরে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার প্রয়োগের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, এতটাই অপপ্রয়োগ হয়েছে যে অনেক প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর হয়েছে। ফলে আমাদের আরও অনেকটা অপেক্ষা করতে হবে এটা দেখতে যে মার্কিন শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা চাপ নিতে পারে।

এ নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় অবশ্যই তাঁর, কিন্তু এ বিজয় চারিত্রিক সততার ও শিষ্টাচারের; মানুষের প্রতি অবজ্ঞার বিপরীতে সহানুভূতির বিজয়; এ বিজয় বিজ্ঞানের। এ কথা নিশ্চয় অতিরঞ্জন নয় যে এটা হচ্ছে মার্কিন সমাজের বৈচিত্র্যের বিজয়—সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের দিকে একবার তাকালেই তা বোঝা যায়। জনসেবা বা পাবলিক সার্ভিসে পুরো জীবন কাটানো একজন জো বাইডেনের প্রতি মানুষের আস্থা একার্থে পাবলিক সার্ভিসের প্রতিই আস্থার প্রত্যাবর্তন, গ্ল্যামারের চাকচিক্য নয় বাইডেন-হ্যারিস জুটির আকর্ষণ তাঁদের সাধারণ জীবনের ইতিহাসে।

এসব যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মার্কিন রাজনীতির বিভিন্ন ধারার প্রেক্ষাপটে এটা বোঝা দরকার কোন রাজনীতি বিজয়ী হয়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে চলা নির্বাচনী প্রচারণা এবং বাইডেনের নির্বাচনী প্ল্যাটফর্মের দিকে, তাঁর প্রতিশ্রুতির দিকে তাকালে এটাই স্পষ্ট হয় যে মধ্যপন্থার রাজনীতিই বিজয়ী হয়েছে। দলের অভ্যন্তরে এবং নাগরিকদের সামনে বাইডেন-হ্যারিস যে লক্ষ্য-নীতি-আদর্শ তুলে ধরেছেন, সেখানে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। স্বাস্থ্যব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দিয়ে সবার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থার কথা তাঁরা বলেননি, তাতে আমার প্রত্যাশা পূরণ হয় না, কিন্তু ব্যক্তি খাতকে বাদ দিয়ে একেবারে নাটকীয়ভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বদল সম্ভব নয়, সেই বাস্তবতার ভিত্তিতেই তাঁরা এক মধ্যপন্থা নিয়েছেন। ভোটারদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই মধ্যপন্থার রাজনীতিকে গ্রহণ করেছেন জনতুষ্টিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিপরীতে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যে ৭১ মিলিয়ন মানুষ ভোট দিয়েছেন তাঁরা এ সমাজের মানুষ, এ দেশের নাগরিক। তাঁদের কাছে যা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি।

জো বাইডেনের এ বিজয়ের বার্তা কী? শনিবার সন্ধ্যায় তাঁর বিজয় ভাষণে বাইডেন বলেছেন, এ বিজয়ের ম্যান্ডেটের একটি হচ্ছে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতার ম্যান্ডেট। মার্কিন নাগরিকেরা চান রাজনীতিবিদেরা পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। বাইডেনের এ বক্তব্য লক্ষণীয় এ কারণে যে যেকোনো বিজয়ের পর বিজয়ী বলেন, ‘জনগণ আমাকে আমার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ম্যান্ডেট দিয়েছে।’ কিন্তু বাইডেন তাঁর বিপরীতে গিয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে একত্রে কাজের আহ্বান জানালেন, ঐক্যের কথা বললেন। গত এক দশকে মার্কিন সমাজে যেভাবে মেরুকরণ হয়েছে, গত চার বছরে বিভক্তিকে যেভাবে উসকে দেওয়া হয়েছে, সমাজের ভেতরে উগ্রপন্থার যে বিস্তার ঘটেছে, সেই সমাজে সহযোগিতার পথ তৈরি করা দুরূহ, আর তা কেবল জো বাইডেনে একার পক্ষে সম্ভব নয়, ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে সম্ভব নয়—তার জন্য দরকার হবে রিপাবলিকান পার্টির সহযোগিতা।

রিপাবলিকান পার্টির নেতারা এ নির্বাচন থেকে এ বার্তা পাচ্ছেন কি না, সেটা স্পষ্ট নয়; এটাও স্পষ্ট নয় যে রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে যে উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে, তাতে তার ভবিষ্যৎ কী। এসব প্রশ্নের উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না; কিন্তু আগামী কয়েক দিনেই তার লক্ষণ বোঝা যাবে। রিপাবলিকান পার্টির নেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণের ব্যাপারে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান, ক্ষমতা হস্তান্তরের আইন ও প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে যে ধরনের হুমকি ট্রাম্প দিচ্ছেন, সেগুলো তাঁরা মোকাবিলা করেন কি না, তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে মার্কিন রাজনীতি কোন পথে এগোবে।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর