জ্বালানির চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিল। মাথাপিছু আয়, বিদ্যুতের খরচ, শিক্ষার হার, বেকারত্বের হার, দারিদ্র্যের হার, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি সূচকের বিবেচনায় বিশ্বব্যাংক ২০১৪ সালে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন–মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। নিম্ন–মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার মূলে বিবেচিত হয়েছে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার, মাথাপিছু বিদ্যুৎ খরচ ৩৪৮ কিলোওয়াটঘণ্টা, শিক্ষার হার ৭০ শতাংশ, দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশ, নিম্নমুখী শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, পুষ্টিহীনতার হার, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি।
২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির সময় বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেতে চায়। এ জন্য যা যা করা দরকার সরকার তা করতে বদ্ধপরিকর। মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিতি পেতে মাথাপিছু আয় ও বিদ্যুৎ ব্যবহার কমপক্ষে করতে হবে যথাক্রমে ৪ হাজার ৬৪৫ মার্কিন ডলার ও ১ হাজার কিলোওয়াটঘণ্টা এবং দারিদ্র্যের হার হতে হবে ১৪ শতাংশের নিচে। সঙ্গে আরও অনেক কিছু। আর মাত্র পাঁচ বছর পর দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে সরকার যে চ্যালেঞ্জ নিয়েছে, তা বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা পালনকারী দুটি সূচক অর্থাৎ মাথাপিছু আয় ও বিদ্যুৎ সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে হলে যা করা দরকার, সে ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্প—এসব অঙ্গীকারই তার প্রকৃত নিদর্শন। আসা যাক ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া প্রসঙ্গে। কেননা, বিদ্যুতের সঙ্গে আয় ও জীবনমানের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর গত সাত বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ও বিতরণে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু এরপরও ৪০ শতাংশ লোক এখনো বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে। যে দেশ যত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, সে দেশ তত উন্নত। তাহলে মধ্য আয়ের দেশ হতে হলে মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ৬৪৫ মার্কিন ডলার ও বিদ্যুৎ খরচ প্রায় ১ হাজার কিলোওয়াটঘণ্টা কীভাবে করা সম্ভব? সরকার ইতিমধ্যে ২০২১ সালকে বিবেচনায় নিয়ে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণ করেছে। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি) ২০১০ অনুযায়ী ২০২১ সালে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা নির্ধারণে একটি সুষম জ্বালানিনীতি গ্রহণ করে। এর মধ্যে গ্যাসের বর্তমান নির্ভরতা ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪২ শতাংশ করা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪২ শতাংশ ধরে রাখতে এলএনজি আমদানি এবং এর জন্য মহেশখালীতে একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ২ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ছয়টি কয়লাক্ষেত্রের মধ্যে শুধু বড়পুকুরিয়া কয়লাক্ষেত্রের কয়লা উত্তোলন করে ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে এবং আরও একটি ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন। ৬ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০২১ সালের মধ্যে করতে হলে কমপক্ষে ছয়টি ১ হাজার মেগাওয়াটের অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে নির্মাণাধীন ও চুক্তিবদ্ধ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি ও বাস্তবতা বিবেচনায় আনলে কাজটি অত্যন্ত দুরূহ বলে মনে হচ্ছে। তার মধ্যে দেশীয় কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে এখনো কয়লানীতি চূড়ান্ত হয়নি এবং আমদানিনির্ভর কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হলে প্রয়োজন গভীর সমুদ্রবন্দর, রেলপথ ও কয়লা মজুত রাখার অবকাঠামো, যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। উচ্চমূল্যের কারণে আমদানিনির্ভর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩০ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশে আনার পরিকল্পনা করছে সরকার। যদিও তেলের বর্তমান দাম বিগত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং এই নিম্নমুখী প্রবণতা বিভিন্ন কারণে আগামী কয়েক বছর অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
অপর দিকে ২০১৫ সালে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (১১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট) ৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করার পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবে সম্ভব হয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে দেশের সম্ভাব্য মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের (২০ হাজার মেগাওয়াট) ১০ শতাংশ কীভাবে করা সম্ভব, তা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন। পারমাণবিক জ্বালানি থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও তা কোনো ক্রমেই ২০২২–২৩ সালের আগে সম্ভব হচ্ছে না। এখন শুধু সম্ভাবনা রয়েছে আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি। তা–ও নির্ভর করছে জ্বালানি বিষয়ে দক্ষ কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা, গ্রিড লাইন নির্মাণ, ট্যারিফ নির্ধারণ, লাগসই প্রযুক্তি, সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎসহ আরও অনেক কিছু।
তাহলে ২০২১ সালে দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে মাথাপিছু যে আয় ৪ হাজার ৬৪৫ মার্কিন ডলারে পৌঁছানো দরকার, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর। ২০২১ সালে মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্রয়োজন হবে প্রায় ১ হাজার কিলোওয়াটঘণ্টা। কিন্তু পিএসএমপি ২০১০ সালের পরিকল্পনা তথা বাস্তবতার নিরিখে ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে ১৮ থেকে ২০ হাজার মেগাওয়াট এবং মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার হতে পারে ৫০০-৬০০ কিলোওয়াটঘণ্টা। এই বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে গ্রামাঞ্চলে শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠা, জনে জনে মোবাইল, কম্পিউটার, ট্যাব, স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ১৪ শতাংশে আনা দুষ্কর হবে। ফলে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া হবে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ।
পিএসএমপি সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা হয় বিধায় সরকারের রূপকল্প (ভিশন) ২০২১ অর্জন করতে হলে বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন পিএসএমপিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা আনা এখনই প্রয়োজন। নিম্নে প্রস্তাবিত সুপারিশের ওপর এনার্জি সেক্টরের নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনা করলে সরকারের রূপকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা সহায়ক হতে পারে।
১. শক্তি দক্ষতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাল্ব, এসি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারকারীদের উৎসাহ প্রদানের জন্য পলিসির মাধ্যমে সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা; ২. বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে পিএসএমপির জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়নের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ; ৩. জাতীয় জ্বালানি ও বিদ্যুৎনীতিতে এনার্জি কালচার মডেল প্রবর্তনের মাধ্যমে শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী ব্যাপারে সবাইকে উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যে রেগুলেশন প্রণয়ন ও প্রয়োগ। কেননা, এনার্জি কালচার হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎসাশ্রয়ের একটি কার্যকর পদ্ধতি, যা অনেকগুলো সূচকের সমন্বয়ে সৃষ্টি। এনার্জি অডিটের মধ্যে একটি অন্যতম সূচক। এনার্জি কালচার মডেলটি (লেখকের গবেষণাধীন) বিশ্বজুড়ে একটি যুগান্তকারী ও কার্যকর নতুন পদ্ধতি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে; ৪. সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছতা, দক্ষ, অভিজ্ঞ, সৎ, পেশাজীবী ও এনার্জি ডিপ্লোমেসিদের দৃশ্যমান উপস্থিতির মাধ্যমে এনার্জি সেক্টরের বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে নিত্যনতুন কলকারখানা স্থাপন; ৫. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ, অনুসন্ধান, উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জনবল সৃষ্টির জন্য একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ও দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি; ৬. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত সংস্কার কর্মসূচির নামে সরকারি কিংবা পিপিপির মাধ্যমে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বহুবিধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত না করে অঞ্চলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ নামক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং এসব প্রতিষ্ঠান ইউনিফায়েড সার্ভিস রুলের মাধ্যমে পরিচালন কিন্তু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা। ব্যক্তিমালিকানাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ প্রতিষ্ঠানসমূহ অঞ্চলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ প্রতিষ্ঠানসমূহের অধীনে পরিচালন; ৭. ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন কওপ-২১-এ ১৯৫টি রাষ্ট্র প্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বিশ্ব উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে রাখতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্রচলিত প্রযুক্তি বদলে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন বৈপ্লবিক ধরনের পরমাণু ও সৌর প্রযুক্তি প্রবর্তন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তখন তেল, গ্যাস ও কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন তেমন একটা দরকার হবে না।
মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]