জয়িতা, পথে অনেক কাঁটা

অস্ট্রেলিয়ার ১৮ বছরের তরুণ টম স্ট্রেঞ্জার ১৯৯৬ সালে শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচিতে গিয়েছিল আইসল্যান্ডে। সেখানে তার পরিচয় হয় ১৬ বছরের তরুণী থরডিস এলভার সঙ্গে। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপরে প্রেম। মাস খানেক পর ‘স্কুল ড্যান্স’ অনুষ্ঠানে অন্য অনেকের মতোই এলভাও নেচেছিল, গেয়েছিল এবং পান করেছিল। হঠাৎ সে অসুস্থ বোধ করলে নিরাপত্তাকর্মীরা অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে চেয়েছিল। কিন্তু টম এলভাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় এবং নির্জন বাসায় তাকে ধর্ষণ করে। এলভা পরে শুধু স্মরণ করতে পারে যে প্রচণ্ড ব্যথায় তার শরীর আড়ষ্ট ছিল, কিন্তু মস্তিষ্ক কাজ করছিল। অ্যালার্ম ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা গুনতে গুনতে সে হিসাব করছিল কষ্টের সময়টা। কয়েক দিনের মধ্যেই এলভার উপলব্ধি হয়, টম যদিও তার প্রেমিক, তবু তার সঙ্গে সে যা করেছে, তা ধর্ষণ। তত দিনে টম স্ট্রেঞ্জার অস্ট্রেলিয়া ফিরে গেছে।

নয় বছর পরে একদিন এলভার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। সে টমকে একটি চিঠি লিখে জানায় সেদিনের ঘটনাটি কত দুঃসহ ছিল। উত্তরে টম এলভাকে জানায়, এলভার যাতনা নিরসনের জন্য সে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। পরে তারা দুজনে মিলে একটা বই লেখে। বইটার নাম সাউথ অব ফরগিভনেস। তারা দুজন টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘টেড টক শো’তে দর্শকদের সামনে সরাসরি কথা বলে। টম বলে, শুরুতে ঘটনাটি তার কাছে স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্কই মনে হয়েছিল, কিন্তু পরে সে অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করে। এখন সে ভীষণ অনুতপ্ত।

অনুষ্ঠানের পর প্রশংসা ও প্রতিবাদ দুই-ই হয়েছে। প্রতিবাদকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, অনুশোচনা প্রকাশ করলেই কি ধর্ষণের মতো অপরাধ ক্ষমাযোগ্য?  প্রশ্ন ওঠে, এলভা এত দিন পরে এই ধর্ষককে নিয়ে টেলিভিশন দর্শকদের সামনে কেন এসেছে? এলভা বলে, সে এটা জানাতে চায় যে নিজের ঘরেও প্রেমিক দ্বারা ধর্ষিত হওয়া সম্ভব। ১৬ বছর বয়সে এটা তার উপলব্ধিতে আসেনি। সেদিন সে কাউকে কিছুই বলতে পারেনি কারণ তার পূর্ব ধারণা ছিল, শোভন পোশাক পরতে হবে, পান করা যাবে না, তাহলেই নারী নিরাপদ। কিন্তু সেদিন তো এসবের ব্যত্যয় ঘটেছিল। টম দানব ছিল না, তার ছিল মানুষের অবয়ব এবং সে ছিল তার ছেলেবন্ধু। আর টমের বক্তব্য হলো, সে এসেছে নিজের অপরাধবোধ ব্যক্ত করতে এবং এলভার দীর্ঘ মানসিক যাতনা লাঘবে যেকোনো কিছু করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে।

বাংলাদেশেও ১৯৯৬ সালে সীমা চৌধুরী নামে এক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। সে প্রেমিকের আহ্বানে চট্টগ্রামের রাউজানে সন্ধ্যার পথ ধরে হাঁটছিল। রাউজান থানার পুলিশ তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়, তিনজন পুলিশ তাকে ধর্ষণ করে। ৯ অক্টোবর রাতের ওই বর্বরতা গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছিল। যেহেতু সীমা চৌধুরী তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক, রাষ্ট্র তাকে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নিয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা কারাগারের ‘নিরাপদ হেফাজতে’ রহস্যজনকভাবে সীমার মৃত্যু হওয়ার পর অ্যাডভোকেট এলিনা খান তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়ী করে মামলা করেছিলেন। ফলাফল অশ্বডিম্ব। প্রতিবাদের ঝড়ের মাঝে এমন ফিসফাসও ছিল, তখন সন্ধ্যার অন্ধকারে সীমা বের হয়েছিল কেন? ২০১২ সালে ভারতের দিল্লি শহরে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন নির্ভয়া। ধর্ষণ ও নির্মম দৈহিক নির্যাতনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। বিবিসির তথ্যচিত্র নির্মাতা লেসলি উডউইনের ইন্ডিয়াস ডটার-এ মামলার এক আসামি মুকেশ সিং বলেছে, ‘ধর্ষণের সময় মেয়েটার ধ্বস্তাধ্বস্তি করা ঠিক হয়নি। চুপচাপ থেকে আমাদেরকে ধর্ষণ করতে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে সব শেষ হওয়ার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হতো।...ধর্ষণের জন্য ছেলেদের থেকে মেয়েরা অনেক বেশি দায়ী। কোনো ভদ্র মেয়ে রাত নয়টায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে না।’...

সম্প্রতি ঢাকার রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও বিচারের দাবিতে জোরালো জনমত গড়ে ওঠে। বিচারপ্রার্থী দুই শিক্ষার্থীর সাহসী অবস্থানও প্রশংসা পায়। তবে একই সঙ্গে  কেউ সরাসরি, কেউ-বা ইনিয়ে-বিনিয়ে ওই দুই তরুণীকেই দায়ী করতে চাইছে। এক গায়ক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘না বুঝেই কমেন্ট করা আর অল্প পরিচিত ধনীর দুলাল বিএমডব্লিউ গাড়ি পাঠালেই লাফ দিয়ে সেই গাড়িতে উঠে হোটেলে গিয়ে বিপদে পড়ার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না।’...স্বনামখ্যাত জনপ্রিয় একজন আবৃত্তিশিল্পী ও প্রশিক্ষক লিখেছেন, ‘দেশে পতিতাপল্লি বৈধ করে দেওয়া উচিত। হয়তো দেশের সাধারণ আর অসহায় মেয়েগুলো বেঁচে যেত।’ অনেক নারীও এই মন্তব্যগুলোতে তাঁদের হ্যাঁ-বাচক সংহতি জানিয়েছেন।

নারীর প্রতি সমাজের এমন একচোখা অন্যায্য দৃষ্টিভঙ্গি কে তৈরি করে? সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত যৌনতা ও সংস্কৃতি গ্রন্থে কথাসাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য কারণ অনুসন্ধান করেছেন এভাবে, ‘...মেয়েরা যেন অসহায় পক্ষিণী, পুরুষই তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। যেন সেজেগুজে কোনো পুরুষকে প্রলুব্ধ করতে পারাতেই মেয়েদের ঐহিক মোক্ষ। বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয় শতকরা পঁচানব্বই ভাগ সাবান শুধু মেয়েরাই মাখে। কেন? এই বিজ্ঞাপনে মেয়েদের খোলামেলা দেখানো যায় বলে? এমন যৌন সুড়সুড়ির উদ্দেশ্যই বা কী?...দুনিয়ার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য এখনো পুরুষের কবজায় আছে বলেই তাদের দৃষ্টিক্ষুধা মেটাতে প্রয়োজন হয় নারী নামক আর এক পণ্যদ্রব্যের?...নারীর জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে এক পেলব কমনীয় ইমেজ, আর পুরুষের জন্য বীর বীর ভাবমূর্তি?’...

এ রকম হাজারো বিশ্লেষণ নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে সমাজমনস্ক দরদি মানুষের কথায় ও লেখায়। কিন্তু এই অন্ধকার, এই অধঃপাত থেকে উত্তরণের উপায় কী? আইন ও বিচারব্যবস্থা কতটুকু সুরক্ষা দেয় নারীদের? জুয়েলারি ব্যবসায়ী ও হোটেল ব্যবসায়ী বাবারা সন্তানদের লাম্পট্যকে বৈধতা দিয়ে কদর্য আস্ফালন করেই চলেছেন।

আর যে দুজন নির্যাতিত তরুণী সাহসের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে উজানস্রোত ঠেলে হাঁটতে শুরু করেছেন, তাঁদের বাসার সামনে কিছু গণমাধ্যমের জুমলেন্স লাগানো ক্যামেরায় চোখ রেখে ওত পেতে থাকা পুরুষ মনোভাবাপন্ন চোখগুলো কি ওই দুই জোড়া চোখের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে ফ্রেমবন্দী করতে পারবে?

ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী ভয়কে জয় করে এগিয়ে এসেছেন।

জয়িতা, আপনাদের অভিবাদন জানাই। আপনাদের জন্যই এই কবিতা।

কাঁধে হাত রাখা পরস্পর

দুই জোড়া ব্যথাতুর চোখ।

বেহায়া সমাজ বেকুব প্রশ্ন করুক;

সাহসিকা, দ্বিধাহীন জয় হোক।

মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক  সংস্কৃতিকর্মী