টিকা কূটনীতি, ভারতের নিষেধাজ্ঞা, আমাদের শিক্ষণীয়

২০১৯ সালের শেষ এবং ২০২০–এর শুরুতে কোভিড–১৯ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে রোগের গতি–প্রকৃতি অনুধাবন করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্তে আসেন যে এ রোগের বিরুদ্ধে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের জন্য ব্যাপক হারে টিকা প্রদানই একমাত্র উপায়। তখন থেকেই টিকার অন্বেষণ শুরু হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কিছু টিকা উদ্ভাবিত হয়। সারা বিশ্বে এখন টিকা প্রদান চলছে। তবে দরিদ্র দেশগুলো টিকা জোগাতে তেমন সফল হয়নি।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। গত বছর নভেম্বরে বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগকে সরবরাহ করার জন্য সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে তিন কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি সম্পাদন করে। তার মধ্যে দেড় কোটি ডোজের মূল্য বাংলাদেশ সরকার পরিশোধ করেছে। সেরাম ইনস্টিটিউট প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ হারে ৬ মাসে এ টিকা বেক্সিমকোকে দেওয়ার কথা। ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালানটি বাংলাদেশে পৌঁছায় ২৫ জানুয়ারি ২০২১। ২০ লাখ ডোজের দ্বিতীয় চালান আসে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। দ্বিতীয় চালানের বাকি পরিমাণ আসার কথা ছিল মার্চের প্রথম সপ্তাহে। একই সময়ে কোভ্যাক্স থেকে অনুদান হিসেবে আরও কিছু টিকা পৌঁছার কথা।

কিন্তু প্রতিশ্রুত টিকাগুলোর কোনোটাই পৌঁছায়নি। ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ৩২ লাখ ডোজসহ মোট এক কোটির কিছু বেশি টিকা এসেছে বাংলাদেশে। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৮ লাখ ১৮ হাজার মানুষ প্রথম ডোজ নিয়েছেন। ৮ এপ্রিল থেকে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয় এবং এযাবৎ দেওয়া হয়েছে ২৩ লাখ ২৭ হাজার জনকে। প্রথম ডোজ নেওয়া বাকিদের দ্বিতীয় ডোজ দিতেই যেখানে প্রয়োজন আরও প্রায় ৩৫ লাখ ডোজ, সেখানে মজুত আছে মাত্র ২১ লাখ ডোজ। ঠিক এ সময়ে ভারতে করোনার অভূতপূর্ব বিস্তার ঘটে এবং একই সঙ্গে সেরাম ইনস্টিটিউট নানা কারণে তাদের প্রত্যাশিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। সংকট সামাল দিতে দিশেহারা ভারত সরকার টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের জন্য এ সিদ্ধান্ত একটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গতকাল থেকে। তারপরও ১৩–১৪ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

টাকা যদিও বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে, সেরামের সঙ্গে চুক্তি সরকারি কোনো কোম্পানি করেনি, করেছে ব্যক্তিমালিকানাধীন বেক্সিমকো। সে চুক্তি অনুযায়ী বেক্সিমকোর উচিত সেরামের ওপর চাপ দেওয়া। পরিবর্তে বেক্সিমকোর এমডি প্রথমে বলেছেন তাঁরা চেষ্টা করছেন, সরকারও চেষ্টা করলে ভালো হয়। সবশেষে ২৪ এপ্রিল তিনি ভারতের সঙ্গে ‘শক্তভাবে কথা বলা’র উপদেশ দিয়েছেন। বেক্সিমকো এবং সেরামের মধ্যে এটি একটি বাণিজ্যিক চুক্তি। শক্তভাবে তাই কথা বলতে পারে বেক্সিমকো, বাংলাদেশ সরকার নয়।

কূটনৈতিক মাধ্যমে যা করা যায় তা হলো অনুরোধ, সেটা করেছে বাংলাদেশ। প্রাথমিক জবাবে ভারত তাদের অপারগতার বিষয়টিই জানিয়েছে বলে জানা যায়। হাল ছেড়ে দিলে অবশ্য চলবে না। কূটনৈতিক পর্যায়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে যে টিকার জন্য মূল্য পরিশোধ করা হয়ে গেছে, অন্তত সেই অবশিষ্ট ৮০ লাখ ডোজ যেন বাংলাদেশকে দিয়ে দেওয়া হয়। আর ১৫ মের মধ্যে আমাদের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই যেন অন্তত ২০ লাখ ডোজ সরবরাহ করা হয়, যাতে যাঁরা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাঁরা সবাই দ্বিতীয় ডোজ পেতে পারেন। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়েও কথা বলতে হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশা ব্যক্ত করেছেন, মে মাসে সেরাম থেকে ২০ লাখ ডোজ পাওয়া যাবে।

ভারতের বাইরেও টিকা কূটনীতিতে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। টিকার জন্য রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে টিকার মজুত গড়তে চীনের প্রস্তাবিত মঞ্চে যোগদানেও সম্মতি জানিয়েছে বাংলাদেশ। কোভ্যাক্স থেকে জরুরি ভিত্তিতে কিছু টিকা পাওয়ারও চেষ্টা করা হচ্ছে।

ভারত যেভাবে টিকার চালান আটকে দিয়েছে, এটা একরকম বিশ্বাসভঙ্গ, যা বন্ধুপ্রতিম একটি দেশের পক্ষ থেকে অপ্রত্যাশিত এবং অগ্রহণযোগ্য। তবে ভারত এ পদক্ষেপ নিয়েছে তাদের নিজ দেশে গভীর সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে, আর সংকটে অনেক সময়ই মানুষ স্বার্থপরের মতোই আচরণ করে। এরূপ একটি আশঙ্কা কথা আমাদের সরকারের মাথায় রাখা দরকার ছিল

বাংলাদেশ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আরও একটি পদক্ষেপ নিতে পারে। জন কেরি তাঁর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরকালে বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রে টিকাদান একটা পর্যায়ে পৌঁছার পর যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত টিকা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশকে দেবে। ভারতে কোভিড সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে হোয়াইট হাউস উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এ ব্যাপারে ভারতকে সহায়তার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্স মার্কিন সংগ্রহে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার যে প্রয়োজনাতিরিক্ত মজুত রয়েছে, তা ভারত, ব্রাজিল ও অধিক আক্রান্ত (‘হার্ড হিট)’ অন্যান্য দেশে পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে। এর খানিক অংশ বাংলাদেশ যাতে পেতে পারে, সে উদ্যোগ নেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়।

সাধারণত চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। এই যে একটা সংকটের মধ্যে আমরা পড়লাম, এ থেকে কী শিক্ষা নেওয়া যায়? প্রথম শিক্ষা, এমন ব্যাপক একটি কার্যক্রমের জন্য একক উৎসের ওপর নির্ভর করা নির্বুদ্ধিতা ছিল। ভারত যেভাবে টিকার চালান আটকে দিয়েছে, এটা একরকম বিশ্বাসভঙ্গ, যা বন্ধুপ্রতিম একটি দেশের পক্ষ থেকে অপ্রত্যাশিত এবং অগ্রহণযোগ্য। তবে ভারত এ পদক্ষেপ নিয়েছে তাদের নিজ দেশে গভীর সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে, আর সংকটে অনেক সময়ই মানুষ স্বার্থপরের মতোই আচরণ করে। এরূপ একটি সম্ভাবনার কথা আমাদের সরকারের মাথায় রাখা দরকার ছিল।

দুই, ভারত যদি শিডিউল অনুযায়ী তিন কোটি টিকা দিতও, তবু হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাপক হারে টিকা দেওয়ার জন্য এ সংখ্যা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। তাই প্রয়োজনীয় টিকার জন্য বিকল্প উৎসের সন্ধান শুরু থেকেই অপরিহার্য ছিল। চীন–রাশিয়ার সঙ্গে উদ্যোগও অন্তত দুই মাস আগেই নেওয়া যেত।

তিন, দু–এক মাস পর যখন ভারতের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং সেরামের সক্ষমতা বাড়বে, তখন তারা নিজ থেকেই টিকা বিক্রির চেষ্টা করবে বাংলাদেশে এবং মূল্য সাশ্রয়ী হলে আমরাও কিনব। তবে যখন যা সরবরাহ হবে, সব সময়ই অর্ধেক টিকা দ্বিতীয় ডোজের জন্য রেখে প্রথম ডোজ দিতে হবে। সরবরাহ ঠিক থাকবে, এমন বায়বীয় আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে আবার সংকটে পড়া যাবে না।

সবশেষে, টিকা তৈরির সক্ষমতা ছিল বাংলাদেশের দীর্ঘদিন ধরে। পরে যখন প্রযুক্তির উন্নতি হলো, তখন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ এবং প্রয়োগ না করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে আমাদের টিকা উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। সময় এসেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে আবার টিকা উৎপাদনে যাওয়ার। রাশিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে যে সামান্য নড়াচড়া শুরু হয়েছে, এটা গুরুত্বের সঙ্গে ফলোআপ করা দরকার। আগামী দিনে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে অন্যতম টিকা উৎপাদনকারী দেশ। শুধু নিজেদের জন্য নয়, বিশ্ববাজারের জন্যও। টিকার প্রয়োজন বহাল থাকবে দীর্ঘদিন, হয়তোবা চিরদিন।

বাংলাদেশে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু বেড়েছে অনেক। বাড়ির পাশে ভারতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সংক্রমণ, যা আমাদের জন্য একটি অশনিসংকেত। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, অতীত থেকে শিক্ষা না নিলে আমাদের এখানেও ভারতের মতো পরিস্থিতি হতে পারে। তা যাতে না হয়, সে ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। দুই সপ্তাহের জন্য ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করা একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। প্রয়োজনে এটা বাড়ানোও যেতে পারে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসচেতনতা এবং বিধিবিধান মেনে চলা রপ্ত করতে হবে বড়সড় বিপর্যয় এড়াতে হলে।


মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব