টিকা নিয়ে রসিকতা

বাংলাদেশের মানুষের রসবোধ শুকিয়ে যায়নি। করোনা তাদের পরাজিত করতে পারেনি। সত্য বটে, আমরা আমাদের অনেক প্রিয়জন হারিয়েছি কোভিডে। তবু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেনের তুলনায় বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি অনেক ভালো। যাঁরা গেছেন, তাঁরা তো গেছেনই; যাঁরা আছেন, তাঁরা বিপদে-সম্পদে মুখের হাসিটা যে ধরে রেখেছেন, সেটাও কিন্তু দেখার মতো, বলার মতো।

টিকা নিয়ে সামাজিক মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে যাচ্ছে রসিকতায়। যেমন এখানে কোভিড টিকা নেওয়ার সময় ঠেসে ধরার জন্য লোক ভাড়া পাওয়া যায়।

মেয়েদের জামা, ব্লাউজের হাতার একটা ডিজাইন আছে, তাতে বাহুর ওপরের দিকে হাতাটা কাটা থাকে। সেই কাটা জায়গা গোলাকারও হতে পারে, পানের পাতা বা হৃদয়াকারও হতে পারে। ফেসবুকে সে ধরনের পোশাকের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে, এখানে কোভিড টিকা নেওয়ার ড্রেস কিনতে পাওয়া যায়।

রসিকতা চরম পর্যায়েও যেতে পারে। বলা হচ্ছে ভাগ্যিস টিকা দিতে হয় বাহুতে, কোভিডের টিকা যদি সাপোজিটরি হতো, তাহলে বাঙালি ফটো দিত কী করে?

কোভিড–প্রতিরোধক টিকা নিয়ে ছবি দেওয়াটা ভালো। কারণ, মূর্খ এবং মতলববাজেরা এই টিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে শুরু করেছিল। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে টিকাবিরোধীরা হেরে গেছেন। এর পেছনে আছে টিকা নিয়ে ছবি দেওয়ার চল। নেতারা ছবি দিলেন, মন্ত্রীরা ছবি দিলেন, সবচেয়ে কাজে লেগেছে বোধ হয় ডাক্তারদের নিজেদের টিকা নেওয়া এবং তার ছবি প্রকাশ ও প্রচার করা।

টিকা নিয়ে ফেসবুকে প্রচারিত রসিকতাগুলোর মধ্যে আছে টিকা ফরম ও ন্যাশনাল আইডি নিয়ে টিকাকেন্দ্রে গিয়ে দেখব না তো, আগের রাতেই সব টিকা দেওয়া হয়ে গেছে!

খবরের কাগজে পড়লাম, নাটোরে এক নেতা টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে শাড়ি আর লুঙ্গি বিতরণ করেছেন। ঘটনাটা নাটোরে ঘটায় এ নিয়ে আমি স্ট্যাটাস লিখেছি—

‘বলেছে সে, এত দিন কোথায় ছিলেন?

টিকা নিয়ে শাড়ি পেয়ে নাটোরের আলতা হোসেন।’

আজকাল কোনো কিছু লিখে শান্তি নেই। এটা স্ট্যাটাস হিসেবে দেওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুনতে পেলাম, জীবনানন্দ দাশ নামের একজন এটা নকল করে কবিতা লিখে ফেলেছেন।

আমি নিজে টিকার পক্ষে যে প্রচারে নেমেছি, তা নিশ্চয়ই এই কলামের নিয়মিত পাঠকদের অজানা নেই। টিকা নিলে কারও কারও কিছুটা প্রতিক্রিয়া তো হতেই পারে। মনে আছে, ছোটবেলায় যখন বসন্তের টিকা দিতে, যক্ষ্মার টিকা দিতে স্কুলের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে লোক আসত, আমাদের মধ্যে কী চাঞ্চল্যই না দেখা দিত! একজন–দুজন অসমসাহসী ছাত্র যে পেছনের দেয়াল টপকে পলায়ন করত না এবং দুর্ভাগা পলাতকদের কাউকে কাউকে তাদের অভিভাবকেরা পাঁজাকোলা করে ধরে ফের টিকাদানকারীদের সামনে হাজির করত না, তা–ও নয়। কত যে কাণ্ড ঘটত! এক মোটাসোটা দারোগা তাঁর ছেলেকে ধরে আনলেন স্কুলে। ‘দেন, টিকা দেন। আমরা কত টিকা নিলাম। আমরা ভয় পাই না। চোর–ডাকাত–বাঘ ভয় পাই না। আর তো টিকা!’ তো, ছেলের জামা খোলা হলো। ইনজেকশনের সিরিঞ্জে ওষুধ ভরা হচ্ছে। ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে, ‘আব্বা, একনাও দুঃখু নাগে না আব্বা, মজা...!’ ঠাস। কোথায় আব্বা। তিনি ধপাস করে পড়ে গেছেন। জ্ঞান হারিয়েছেন।

বসন্তের টিকায় আগে একটা চক্রাকার নারকেল কুরুনির মতো জিনিস দিয়ে দেওয়া হতো, হাতে গর্ত করে। পরে সুচ দিয়ে চার–পাঁচবার খোঁচা দিয়ে। পরে ব্যাপারটা ভদ্রস্থ হয়েছে। আমাদের সবারই হাতে-পায়ে বড় বড় টিকার দাগ। বসন্তের টিকা নেওয়ার পর ঘা হতো, বিসিজি টিকা নেওয়ার পর অনেকেরই জ্বরজারি আসত। বাংলাদেশে স্লিভলেস জামা যে জনপ্রিয় হতে পারল না, তার একটা কারণ হয়তো টিকার দাগে দাগি হাত-পা।

আমরা পাঁচ ভাইবোন ঢাকায় থাকি। প্রত্যেকের একজন করে স্পাউজ বা জীবনসঙ্গী মিলে ১০ জন। আমরা ১০ জনই কোভিডশিল্ড টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে নিয়েছি। প্রত্যেকেই অনলাইনে নাম নিবন্ধন করে টিকা ফরম প্রিন্ট নিয়ে যার যার মতো করে হাসপাতালে গিয়ে টিকা নিয়েছি। সবাই খুশি। ব্যবস্থাপনা খুব ভালো। ভ্যাকসিন ফ্রি। আমি একদম টের পাইনি, বরং সিস্টার আমার বাহু চেপে ধরেছিলেন, সেইখানে ব্যথা লাগছিল, কখন সুচ ফোটাবে, তার জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি বললেন, হয়ে গেছে, ওঠেন। কখন দিল!

বিনা পয়সায় টিকা পেয়েও যে বাঙালি খুশি হচ্ছে না, তাকে আমার বন্ধু প্রকৌশলী শহীদ আকন্দের স্ট্যাটাস পড়তে দিই। তিনি লিখেছেন এটা অ্যারিজোনা, যুক্তরাষ্ট্রে বসে। ‘বাংলাদেশে আমার বন্ধু, আত্মীয়স্বজনরা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন নিচ্ছে। অথচ আমেরিকাতে দুই–দুইটা কোম্পানি ভ্যাকসিন উৎপাদন করলেও এখন পর্যন্ত আমার ভ্যাকসিনের কোনো খবর নাই।’

দেশে অনেক সমস্যা, কিন্তু করোনা মোকাবিলা মোটের ওপর যে আমেরিকা–ইউরোপের চেয়ে ভালো হয়েছে, এটা স্বীকার করতে অসুবিধা কী?

আম্মার কথা মনে পড়ছে। আমরা যখন ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করতাম, ঈদে বাড়ি যাওয়ার সময় আম্মা বলে দিতেন, ‘এক বাসে আসবে না। একেকজন একেক বাসে আসো।’ আম্মা জানতেন, সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে নেই। আম্মা দুবছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা ১০ জন টিকা নিয়েছি। আম্মা নিশ্চয়ই খুশি হয়েছেন।


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক