টিকিট কেটে মহাকাশযাত্রায় কার লাভ

নিজের ব্লু অরিজিন স্পেস ক্র্যাফটে জেফ বেজোস
ছবি রয়টার্স

এ মাসের শুরুতে ব্রিটিশ ধনকুবের উদ্যোক্তা স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন নিজের মালিকানাধীন স্পেসফ্লাইট কোম্পানি ভার্জিন গ্যালাক্টিকের নভোযানে চড়ে সফলভাবে মহাশূন্য থেকে বেড়িয়ে এসেছেন। আর গত সপ্তাহে আরেক ধনকুবের আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস নিজের ব্লু অরিজিন স্পেস ক্র্যাফটে চড়ে মহাশূন্যে গিয়ে রিচার্ড ব্র্যানসনের চেয়ে ১০ মাইল ওপরে চক্কর দিয়ে সফলভাবে ফিরে এসেছেন।

এ দুই ধনকুবেরের মহাকাশ ভ্রমণ ‘মহাকাশ পর্যটনের’ ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করল। এর আগে অতি উচ্চমানের প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী ও পাইলটদের জন্য মহাকাশে পর্যটনের বিষয় সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু ব্র্যানসন এবং বেজোস সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছেন। যাঁদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে কিন্তু কোনো প্রযুক্তিজ্ঞান নেই, তাঁরাও এখন মহাশূন্যে বেড়াতে গিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য ভরহীনভাবে শূন্যে ভেসে থাকার স্বাদ নিতে পারবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের সেই মহাশূন্য পরিভ্রমণের দৃশ্য সরাসরি তাঁদের ফলোয়াররা দেখতে পারবেন। কিন্তু ধনকুবেরদের এই স্রেফ বিনোদনমূলক বিলাসী মহাকাশযাত্রায় তাঁদের আত্মতৃপ্তি ছাড়া আর কার কী লাভ আছে, তা ভেবে দেখার বিষয়।

বিংশ শতকে মহাকাশযাত্রা রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত সম্ভ্রমের প্রতীক ছিল। দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে এ নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। দুই দেশই নতুন নতুন প্রযুক্তিনির্ভর রকেট, স্যাটেলাইট বানানোর পেছনে শত শত কোটি ডলার ঢেলেছে। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই চাঁদের মাটিতে মানুষের পদচারণ সম্ভব হয়েছে। শীতল যুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় তহবিল খরচ করে স্পেস প্রকল্প বাস্তবায়নের রাজনৈতিক চাপ শেষ হয়ে গেছে। সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি খাত।

ব্র্যানসনের মহাশূন্যে ঘুরতে যাওয়া ছিল দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। তিনি ২০০৪ সালে নভোযান তৈরি করবেন এবং ২০০৭ সালের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে অর্থের বিনিময়ে প্রশিক্ষণ নেই এমন লোকদেরও মহাকাশ ভ্রমণ করিয়ে আনবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে তা পিছিয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত ভার্জিন গ্যালাক্টিক সফলভাবে মহাশূন্যে গিয়ে ফিরে এসেছে। এর উড্ডয়ন, চলন ও ফিরে এসে অবতরণের ধরনে ব্যাপক প্রযুক্তিগত অগ্রগতি যুক্ত হয়েছে। ভার্জিন গ্যালাক্টিকের যাত্রায় ‘মাদার শিপ’ প্রধান যান ভিএসএস ইউনিটিকে সঙ্গে করে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত গেছে। এরপর ইউনিটি আলাদা হয়ে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আরও ৭০ কিলোমিটার ওপরে গিয়ে মহাশূন্যের সীমায় ঢুকেছে। এরপর ইউনিটি ফিরে এসেছে এবং অবতরণের আগে পালক যেভাবে ঘুরতে ঘুরতে মাটিতে পড়ে, সেই কায়দায় ঘূর্ণমান ডানার সাহায্যে সেটি কোনো ধরনের প্যারাস্যুটের ব্যবহার ছাড়াই সফলভাবে উড্ডয়নস্থলেই নেমেছে। অর্থাৎ বাণিজ্যিকভাবে যেসব যাত্রী মহাশূন্যে ভ্রমণে যাবেন, তাঁদের বাড়তি কোনো ঝামেলা থাকছে না। একেবারেই তাঁরা সাধারণ উড়োজাহাজের মতো নভোযানে উঠতে পারবেন।

জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন নভোযানেও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যুক্ত হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ টু-পার্ট রকেট সিস্টেম। এতে কোনো পাইলটেরই দরকার হয় না। দুটি কোম্পানিই দীর্ঘদিন ‘বেহিসাবিভাবে’ এ খাতে বিনিয়োগ করার পর অবশেষে অঢেল মুনাফার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছাতে পেরেছে। ইতিমধ্যে আট হাজার লোক ভার্জিন গ্যালাক্টিকে টিকিট রিজার্ভ করেছে। একেকটি টিকিটের দাম সর্বনিম্ন আড়াই লাখ ডলার। ব্লু অরিজিনে ওড়ার জন্য ইতিমধ্যে লটারিতে নাম ওঠা ভাগ্যবান ৭ হাজার ৬০০ লোক নাম নিবন্ধন করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে জেফ বেজোসের কোম্পানি ২ কোটি ৮০ লাখ ডলার নিয়েছে।

ব্যাংক অব আমেরিকা হিসাব করে দেখেছে, বর্তমানে স্পেস ইন্ডাস্ট্রির মোট মূলধন ৩৫ হাজার কোটি ডলার এবং ২০৪০ সাল নাগাদ তা ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার আগে আমাদের ভেবে দেখতে হবে এতে আসলে কার কতটা লাভ। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী লোকদের কিছুক্ষণের বিনোদন ছাড়া এটি আর কী কাজে লাগবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে ভার্জিন গ্যালাক্টিক এবং ব্লু অরিজিন হচ্ছে সাব–অরবিটাল মহাকাশযান। এগুলো পৃথিবীর কক্ষপথ পৌঁছাতে সক্ষম নয়। এদের থেকে আরেক ধনকুবের ইলন মাস্কের নভোযান স্পেসএক্স সম্পূর্ণ আলাদা। এটি নাসার পছন্দের নভোযানগুলোর একটি। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ করা থেকে শুরু করে নতুন উপগ্রহ মোতায়েন করতেও সক্ষম। এ প্রযুক্তি সমগ্র মানবজাতির সরাসরি কল্যাণে নিয়োজিত হয়।

রিচার্ড ব্র্যানসন এবং জেফ বেজোস যাতে শুধু বিনোদনভিত্তিক মহাকাশ–বাণিজ্য নিয়ে মত্ত না থাকেন, সে জন্য সরকারগুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

জনি লাক যুক্তরাজ্যের রাজনীতিক ও কৌশলগত উপদেষ্টা