‘টিনের তলোয়ার’ ও মরচেবিহীন ৫০ বছর

‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে উৎপল দত্ত (মাঝে) ও অন্যান্য কুশীলব

‘আমি তহন আদি দীপালি অপেরায়। একবার আর্টিস্টগের বেতন তিন মাস বাকি পড়ল। দলের হিরো সন্তোষ বিশ্বাস গেল ক্ষেইপে। সিরাজ-উদ–দৌলা পালার রিহার্সাল চলতিছিল। তার মধ্যিই সিরাজের ডায়লগ দিতি দিতি সন্তোষ যাত্রাদলের মালিক ধীরেন বাকচির নাম ধইরে গালিগালাজ করা শুরু করল। “শুয়োর কা বাচ্চা...তর নোকরি আর নেহি কারেগা” কইয়েই সে হারমোনিয়ামে মারল লাথি। যা দিয়ে আমরা প্যাট চালাই, তাতে লাথি মারলি? আমার মেজাজ গেল খারাপ হয়ে...।’

এক জ্যোৎস্নাঘন রাতে নিজের ভাঙাচোরা ঘরের সামনের উঠোনে পাতা মাদুরে বসে সিআরদা (সম্ভবত ‘সি আর’ মানে ‘চিত্তরঞ্জন’) এইভাবে গল্প বলছিলেন। বছর দশেক আগে দেশের বাড়ি গোপালগঞ্জে ঈদের ছুটিতে গিয়ে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। যখন তাঁর কাছ থেকে তাঁর যাত্রাদলে অভিনয় করার গল্প শুনছিলাম, তখন তিনি বেশ বয়স্ক মানুষ। গ্যাংগ্রিন হওয়ায় দুটো পা-ই কোমরের নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছিল। কঠিন দারিদ্র্য আর অবহেলায় তাঁর চোখ তখন ঝাপসা। যখন সিআরদার গল্প শুনছিলাম, তখন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাংলা নাটক টিনের তলোয়ার-এর দ্বিতীয় ও শেষ দৃশ্য।

টিনের তলোয়ার নাটকের কাহিনি মূলত দ্য গ্রেট বেঙ্গল অপেরা নামের একটি যাত্রাদলকে ঘিরে। এই নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায়, বেঙ্গল অপেরার মহড়াকক্ষে রিহার্সাল চলছে। রাজা-রানির পাঠ মুখস্থ করতে হচ্ছে, অথচ দুপুরের বাজার করার টাকা নেই। শিল্পীদের মুড়ি খেয়ে খিদে মেটাতে হচ্ছে, অথচ রিহার্সালে ময়ূরবাহন নাটকের কাশ্মীরের রাজা-রানি-যুবরাজের সংলাপ আওড়াতে হচ্ছে। আর সিআরদার গল্পে দীপালি অপেরার হিরো সন্তোষ যেমন সিরাজ–উদ দৌলার সংলাপ ঝাড়তে ঝাড়তে দলের মালিক ধীরেন বাকচিকে গালি দেওয়া শুরু করেছিলেন, সেভাবে টিনের তলোয়ার-এর শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, প্রধান চরিত্র কাপ্তেন বাবু সধবার একাদশী নাটকে অভিনয় করার জন্য স্টেজে উঠে নিমচাঁদ চরিত্রের সংলাপ বলতে বলতে তিতুমীর নাটকের তিতুমীর চরিত্রের সংলাপ বলতে শুরু করেন।

বাংলাদেশের জন্মের ঠিক চার মাস আগে, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট সন্ধ্যায় কলকাতার রবীন্দ্রসদনে পিপলস লিটল থিয়েটারের প্রথম মঞ্চায়িত নাটক ছিল এই টিনের তলোয়ার। গতকাল বৃহস্পতিবার নাটকটির ৫০ বছর পূরণ হলো। অর্ধশতাব্দী কেটে গেছে। অবাক করা বিষয়, উৎপল দত্তের লেখা সেই টিনের তলোয়ার-এ এত দিনেও এতটুকু মরচে পড়েনি, বরং তাতে ধার বেড়েছে বহুগুণ। সত্যজিৎ রায় নাটকটিকে ‘আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের সর্বোচ্চ শিখর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি লেখায় নাট্য সমালোচক অংশুমান ভৌমিক বলেছেন, ‘এই নাটককে বাদ দিয়ে বাংলা থিয়েটার তো বটেই, আধুনিক ভারতনাট্যের ইতিহাসও লেখা যাচ্ছে না। এমন নাটকের সুবর্ণজয়ন্তী এক অর্থে আমাদের নাট্য-সংস্কৃতিরই বিজয় উৎসব।’

নাটকটির কাহিনির পটভূমি ১৮৭৫ সাল। ব্রিটিশের শাসন চলছে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মিটিং-মিছিল তো দূরের কথা, নাটক-থিয়েটারে সাহেবসুবোদের নিয়ে সামান্যতম ঠাট্টা করাও অপরাধ ছিল। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্রিটিশ রাজের সমালোচনা করলেই নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনে শিল্পী-কলাকুশলীদের গ্রেপ্তার করা হতো।

এর কাহিনিতে দেখা যায়, বেণীমাধব চাটুজ্যে ওরফে কাপ্তেন বাবু দ্য গ্রেট বেঙ্গল অপেরার ‘মাস্টার’। মঞ্চে তাঁর অভিনয় দেখে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা তাঁকে ‘বাংলার গ্যারিখ’ উপাধি দিয়েছে। আর এই দলের স্বত্বাধিকারী হলেন অঢেল টাকাপয়সাওয়ালা মুৎসুদ্দি ‘ক অক্ষর গোমাংস’ বীরকৃষ্ণ দাঁ। বীরকৃষ্ণ লেখাপড়া জানেন না, কিন্তু টাকার জোরে ‘সাহিত্য করেন’, নিজের নামে নাটক লেখানোর জন্য সাহিত্যসম্রাট ও তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে পর্যন্ত ভাড়া করতে চান।

নাটকের প্রথম দৃশ্যেই কাপ্তেন বাবুকে ‘কোলকেতার তলায় থাকি’ বলে পরিচয় দেওয়া একজন মেথর ভর্ৎসনা করেন। সেই মেথরের চুম্বক কথা হলো, কাপ্তেন বাবুর মতো অভিনেতারা সাহেবদের বিনোদন দিতে মঞ্চের ওপর রাজা-উজির সেজে টিনের তলোয়ার হাতে ‘ছেলেমানুষি’ করেন, কিন্তু তাঁর মতো মেথরের চরিত্র নিয়ে গল্প ফেঁদে নাটক বানান না। কারণ, তাতে ‘চাটুজ্যে বামুনের জাত যাবে না!’

যেকোনো কর্তৃত্ববাদ ও নিবর্তন ব্যবস্থার সামনে দুর্বল জনতার অবনত থাকার চিরায়ত চেষ্টা ও তাঁদের অন্তঃস্থ ক্ষোভের আকস্মিক উদ্‌গিরণের প্রতীক টিনের তলোয়ার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও শিল্পসাহিত্যের ওপর মূর্খ পেশিশক্তির ছোবলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সেই তলোয়ার আজও মরিচাবিহীন। আজও ধারালো।

পরের দৃশ্যগুলোয় এ বিষয়ই ঘুরেফিরে আসে। বেঙ্গল অপেরা থেকে দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী নাটক নামানো হয়েছিল। সেই নাটকে ‘সাহেবদের গাল দেওয়া হয়েছে’ বলে দলের মালিক বীরকৃষ্ণ কাপ্তেন বাবুকে এসে বলেন, এ নাটক অশ্লীল। এতটাই অশ্লীল যে পাশে রক্ষিতা নিয়ে তা নাকি দেখা যায় না। বীরকৃষ্ণ চান এমন নাটক মঞ্চস্থ হোক, যাতে সাহেবদের কোনো সমালোচনা থাকবে না। সে ক্ষেত্রে রাজা-বাদশাহর কাহিনিধর্মী ময়ূরবাহন নাটকই ভালো। তাতে নির্ভেজাল বিনোদন আছে, কিন্তু সরকারের অসংগতির প্রতি কোনো শ্লেষ নেই।

এ বাস্তবতাবিবর্জিত স্থূল বিনোদনের নাটক মঞ্চায়নে অতি বিরক্ত হয়ে প্রিয়নাথ মল্লিক নামের এক উঠতি ডিরোজিয়ান বুদ্ধিজীবী ও তরুণ নাট্যকার কাপ্তেন বাবুর কাছে এসে ক্ষোভ ঝাড়ে। সে নিজের লেখা পলাশীর যুদ্ধ নামের একটি নাটক কাপ্তেন বাবুকে পড়তে দিলে কাপ্তেন বাবু সেটি না পড়ে তা মুড়ির ঠোঙা হিসেবে ব্যবহার করে নষ্ট করেন। পরে তাঁর লেখা আরেকটি নাটক তিতুমীর মঞ্চস্থ করতে রাজি হন কাপ্তেন বাবু। কিন্তু তা আর মঞ্চায়ন সম্ভব হয় না। কারণ, এ ধরনের সরকারের সমালোচনা করে নাটক মঞ্চায়নের জন্য নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনে অন্য আরেকটি দল দ্য গ্রেট ন্যাশনাল অপেরার সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়। সহশিল্পীরা বিদ্রোহ করে তিতুমীরই মঞ্চায়ন করতে চায়। কিন্তু এতে শিল্পীদের গ্রেপ্তার হতে হবে এবং তাতে তাদের পরিবার বিপদে পড়বে ভেবে কাপ্তেন বাবু অন্য নাটক নিয়ে মঞ্চে আসেন। তবে তিতুমীর নাটকের ‘রক্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়া’ সংলাপ তাঁর মাথা থেকে যায় না।

নাটকের শেষে দেখা যায়, সধবার একাদশী পালার নিমচাঁদ চরিত্রে অভিনয় করতে কাপ্তেন বাবু আকণ্ঠ মদ খেয়ে টলতে টলতে যাত্রার স্টেজে ওঠেন। তাঁর সামনে দর্শকের সারিতে বসা ব্রিটিশ সাহেব ক্যাপ্টেন ল্যাম্বার্ট আর তাঁর চ্যালা মুৎসুদ্দিরা। হঠাৎ কাপ্তেন বাবুর রক্ত বিদ্রোহ করে। তিনি নিমচাঁদ চরিত্রের সংলাপ বাদ দিয়ে অকস্মাৎ টিনের তলোয়ার হাতে ‘তিতুমীর’ যাত্রাপালার সংলাপ বলা শুরু করেন। টিনের তলোয়ার বাগিয়ে তাঁর সামনে বসা ক্যাপ্টেন ল্যাম্বার্টের দিকে চেয়ে তিতুমীরের সংলাপ বলতে থাকেন, ‘সাহেব, তোমরা আমাদের দেশে এলে কেনে? আমরা তো তোমাদের কোনো ক্ষেতি করিনি।...হাজার হাজার ক্রোশ দূর থেকে এ দেশে এসে কেন ওই বুট জোড়ায় মাড়গে দিলে মোদের স্বাধীনতা?’

নাটকের সংলাপ দিয়ে কাপ্তেন বাবু তার সামনে বসা বাস্তবের ইংরেজ সাহেবকে ভর্ৎসনা শুরু করেন তীব্র ভাষায়। এ যেন ব্রিটিশ কামানের সামনে প্রতিবাদী এক ‘ছেলেমানুষি’ টিনের তলোয়ার।

যেকোনো কর্তৃত্ববাদ ও নিবর্তন ব্যবস্থার সামনে দুর্বল জনতার অবনত থাকার চিরায়ত চেষ্টা ও তাঁদের অন্তঃস্থ ক্ষোভের আকস্মিক উদ্‌গিরণের প্রতীক এই টিনের তলোয়ার। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও শিল্পসাহিত্যের ওপর মূর্খ পেশিশক্তির ছোবলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সেই তলোয়ার আজও মরিচাবিহীন। আজও ধারালো।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

[email protected]