টিভি দেখতে গিয়ে শিশুরা কী দেখছে

শুধু বিজ্ঞাপনই নয়, শিশুদের দিয়ে এমন নাচ বা গানও গাওয়ানো উচিত নয়, যাতে রয়েছে বাণিজ্যিক যৌনতার আঁচ
ফাইল ফটো

সেদিন আমার ছোট্ট পাঁচ বছরের ছেলে আমাকে এসে বলছে, ‘মা, কাজের ছেলেরা সারা দিন আমাদের কত কাজ করে দেয়, কিন্তু আমরা তো তাদের কোনো পুরস্কার দিই না। আমাদের উচিত তাদের পুরস্কার দেওয়া।’ আমি কিছু বুঝতে না পারায় অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার চোখ দেখে ও বুঝে গেল আমার না বোঝার ব্যাপারটা। তখন আবার বলল, ‘ওই যে অ্যাডটা, তুমি দেখোনি, আসল পুরুষ প্যানথার? ছেলেটাকে মহিলা অনেক ভালো কাজের জন্য মেডেল দিচ্ছে।’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম আমার ছোট্ট ছেলেটা তার ছোট্ট মগজ খাটিয়ে ভালোই একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। যেহেতু সারা দিন কাজের ছেলেরা প্রচুর কাজ করে, তাই পুরস্কারস্বরূপ বাড়ির মেয়েরা তাদের গলায় মেডেল পরিয়ে দিচ্ছে, যেন তারা মন খারাপ না করে। আমি না হেসে পারলাম না, কিন্তু আমার হাসির চেয়ে মন খারাপই বেশি হলো।

শিশুদের বিনোদনের জন্য আমরা টিভি দেখতে দিই, কিন্তু তাতে যদি বিনোদনের বদলে তাদের মনে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তবে এর দায়ভার তো আমাদের ওপরই বর্তাবে। আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের এসব দেখতে দিচ্ছে, আর তারা তা দেখে প্রভাবিত হতে পারে

আমাদের কোমলমতি শিশুরা বেড়ে উঠছে গণমাধ্যম বিশেষ করে টিভিতে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান দেখে। স্বাভাবিকভাবেই এসব অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখানো হয় এবং এই প্রাইম টাইমে প্রচার করা বয়স্কদের কোনো বিজ্ঞাপন যদি তাদের নজরে আসে, তবে তা তাদের ওপর কতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, তা অভিভাবক হিসেবে আমাদের বোঝা উচিত। এই ধরনের প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী বিজ্ঞাপন দেখে তাদের কোমল মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হতে পারে, যেটা হবার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। শিশুরা যেমনি কোমলমতি, তেমনি তারা অনুকরণপ্রিয়ও বটে। তাই যদি তারা এই প্রাপ্তবয়স্কদের বিজ্ঞাপনগুলো দেখে তার অনুকরণ করতে চায়, তাহলে আমরা তাদের থামাব কী করে?

শিশুদের অনেকগুলো শিক্ষণীয় মাধ্যমের মধ্যে একটি গণমাধ্যমও হতে পারে। আর অভিভাবকদের নাগরিক জীবনের অনেক ব্যস্ততার জন্য বর্তমান সময়ের অনেক বাচ্চাই গণমাধ্যমে, বিশেষ করে টিভিতে অনেক সময় ব্যয় করে। সেখানে দুরন্ত টিভির মতো শিশুদের চ্যানেলে অনেক শিক্ষণীয় প্রোগ্রাম দেখানো হয়। কিন্তু শিশুরা তো শিশু-কিশোরদের চ্যানেলের পাশাপাশি অন্যান্য চ্যানেলও দেখে থাকে। আর সবার জন্য উন্মুক্ত চ্যানেলগুলোতে যদি যখন–তখন প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, তবে সেটা শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রাপ্তবয়স্কদের বিজ্ঞাপন, অনুষ্ঠান কয়েকটি চ্যানেলে নির্দিষ্ট সময়ে হতে পারে, সেটা যদি শিশুরা দেখে, তবে চ্যানেলের কোনো দায়িত্ব নেই, তার দায়দায়িত্ব তাদের অভিভাবকদের। কিন্তু বাংলাদেশের মতো কোনো একটি দেশে প্রাইম টাইমে যেসব দেশীয় চ্যানেল পরিবারের সবাই দেখে, সেখানে যদি নির্দিষ্ট সময় ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, তবে সেটা অবশ্যই অনুচিত। শুধু বিজ্ঞাপনই নয়, শিশুদের দিয়ে এমন নাচ বা গানও গাওয়ানো উচিত নয়, যাতে রয়েছে বাণিজ্যিক যৌনতার আঁচ। আমরা সন্তানের খেলাধুলার জন্য পার্কের ব্যবস্থা করতে পারব না, তাদের দৌড়াদৌড়ি করার জন্য মাঠ দিতে পারব না, ওদের বিনোদনের জন্য আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান করতে পারব না, কিন্তু ওদের মনে ক্ষতিকর দাগ পড়তে পারে—এ রকম আশঙ্কাজনক বিজ্ঞাপন কেন দেখাব! শিশুদের বিনোদনের জন্য আমরা টিভি দেখতে দিই, কিন্তু তাতে যদি বিনোদনের বদলে তাদের মনে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তবে এর দায়ভার তো আমাদের ওপরই বর্তাবে। আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের এসব দেখতে দিচ্ছে, আর তারা তা দেখে প্রভাবিত হতে পারে। বর্তমান এই প্রযুক্তির যুগে আমরা শিশুদের প্রযুক্তির খারাপ প্রভাব থেকে যত সরিয়ে রাখতে পারব, তারা ততই ভালোভাবে ও সঠিকভাবে বেড়ে ওঠবে, তাদের বিকাশ ততই সঠিক হবে।

আমাদের সন্তানেরা বেড়ে উঠছে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে, তাদের নেই খোলা আকাশ, খোলা মাঠ, নেই পাখির মতো ওড়ার সুযোগ। তারা আজ টিভিতে ভার্চ্যুয়াল জগতে বিরাজমান। আর তাদের এই জগৎটা যদি তাদের জন্য নিরাপদ, শিক্ষণীয়, আনন্দদায়ক না হয়ে তাদের জন্য অশুভ, ক্ষতিকর হয়, তবে আমরা যে কী ভীষণ বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাব, তা বোধ করি সবার পক্ষেই বোঝা সম্ভব। তাই টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ যদি কোমলমতি এই শিশুদের কথা বিবেচনায় এনে প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ে দেন, তবে সেটা সবার জন্যই কল্যাণকর হবে। আমরা বাচ্চাদের ভালো কিছু দিতে না পারি, অন্তত খারাপ থেকে যেন দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। এমনকি পশ্চিমা সমাজ—যেখানে মানুষের যৌনতা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমাজের থেকে অনেক আলাদা, সেখানেও প্রাইম টাইমে কী ধরনের অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। আর এই নীতিমালাগুলো শুধু কাগজ–কলমে নয়, এইগুলো কঠোরভাবে নজরদারিও করা হয়। বোধ করি আমাদের নীতিনির্ধারকদেরও এই ব্যাপারে প্রখর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের কারও কোনো অধিকার নেই শিশুদের শৈশবের সারল্য ধ্বংস করার।

মাসুমা সিদ্দিকা: একজন মা।