টোকিওতে ১৯৭২-এর বাংলাদেশের স্মৃতিচারণা

বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুষ্ঠানে জাপানি সাংবাদিক তোশিইয়ুকি সাতো
বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুষ্ঠানে জাপানি সাংবাদিক তোশিইয়ুকি সাতো

বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস এ বছর ভিন্ন ধরনের এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশের সূচনার দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল দুজন প্রবীণ জাপানি সাংবাদিককে, যাঁরা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফর করে চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এসেছিলেন সদ্য স্বাধীন দেশটি থেকে। প্রবাসে বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেই অনুষ্ঠান দুই সাংবাদিকের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন হয়ে উঠেছিল গতানুগতিকতার বাইরে তৃপ্তির অনুভূতি এনে দেওয়া এক আয়োজন, অন্যদিকে সেটা ছিল তরুণ প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশের কঠিন সেই সময়ে বিদেশির চোখে দেখা দেশ ও দেশের সেই সময়ের নেতৃত্ব সম্পর্কে জানতে পারার চমৎকার সুযোগ। ফলে সেই অনুষ্ঠান বিজয় দিবস যেদিন পালিত হয় তার দুই সপ্তাহ পরে অনুষ্ঠিত হলেও দিনটির তাৎপর্য কোনো অবস্থাতেই এর মধ্য দিয়ে ক্ষুণ্ন হয়নি।
রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমার সংক্ষিপ্ত ভাষণের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সেই অনুষ্ঠানে প্রবীণ দুই জাপানি সাংবাদিক ছাড়া আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশে জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও জাপান-বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি মাৎসুশিরো হোরিগুচি এবং পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক জিয়াউল ইসলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা আমন্ত্রিত বক্তা এবং বাংলাদেশের বিদেশি বন্ধু হিসেবে সম্মানিত কয়েকজন জাপানি নাগরিকের পরিবারের সদস্যের গলায় লাল-সবুজ উত্তরীয় পরিয়ে দেন। এরপর টোকিওর বিদেশচর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের একটি বাংলা গান পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান, যা শেষ হয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের পরিবেশিত গানের মধ্য দিয়ে। তবে শুরুতেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, অনুষ্ঠানের মূল প্রাণ সেদিন ছিল প্রবীণ দুই জাপানি সাংবাদিকের স্মৃতিচারণা।
ফুমিও মাৎসুওর বয়স এখন ৮৩ বছর। তবে ৪৪ বছর আগে ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মে জাপানের বার্তা সংস্থা কিওদো নিউজের সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশ সফরের স্মৃতি তাঁর মনে এখনো পরিষ্কার গেঁথে আছে। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সে রকম কিছু দিক তিনি তুলে ধরেন। এর মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ লাভের স্মৃতি। আগে থেকে সাক্ষাতের অনুমতি না নিয়ে কিংবা সে রকম কোনো ব্যবস্থা না করেই কলকাতা থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইট ধরে ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দরে তিনি এসে পৌঁছেছিলেন ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায়। তবে বিমানের ফ্লাইটে ঘটনাক্রমে ইত্তেফাক সম্পাদক মইনুল হোসেনের পাশে আসন গ্রহণ ফুমিও মাৎসুওর সাক্ষাৎকার গ্রহণের সমস্যা অনেকটাই সমাধান করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তাঁকে বলেছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য কাউকেই পূর্ব অনুমতি নিতে হয় না। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যার পর নাগরিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফলে জাপানি সাংবাদিকের পক্ষেও সাক্ষাৎপ্রার্থীদের দলে ভিড়ে গিয়ে অপেক্ষা করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
শুরুতে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও পুরোনো গণভবনে সন্ধ্যায় তিনি ঠিক উপস্থিত হয়েছিলেন এবং অবাক হয়ে দেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে নানা আরজি আর অনুরোধ নিয়ে সাক্ষাৎ করতে আসা সাধারণ নাগরিকদের। তখন তাঁর মনে হয়েছিল বাংলাদেশ যে নিজের পরিচয় হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিদিনের রুটিনের সেটাই তো সেই গণপ্রজাতন্ত্রের প্রকৃত রূপ, জনতা যেখানে নেতার কাছে গিয়ে জানাতে পারছে তাদের অভাব-অভিযোগ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিজের পালা এলে বঙ্গবন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করে জাপানি সাংবাদিকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন এশিয়ার রাজনীতির সাম্প্রতিক অগ্রগতির বিভিন্ন দিক, অনুরোধ করেছিলেন সেসব অগ্রগতির কথা তাঁকে বুঝিয়ে বলতে। ফুমিও মাৎসুও সংক্ষেপে জাপানের রাজনীতির সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতির উল্লেখ করলে গভীর আগ্রহ নিয়ে তিনি তা শোনেন এবং বাংলাদেশের সহায়তায় জাপান যেন এগিয়ে আসে সেই আহ্বান জানান। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা আলাপচারিতায় বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছিলেন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রতি তাঁর অবিচল আস্থার কথা।
তোশিইয়ুকি সাতোর বাংলাদেশ ভ্রমণ ছিল এর প্রায় ছয় মাস পর, ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে। ভিন্ন এক কারণে সেই সফর ছিল অনেক বেশি অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে জাপানের নাগরিক সম্প্রচার কেন্দ্র এনএইচকেতে কাজে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় তিনি তখন ছিলেন। সে রকম অবস্থায় হঠাৎ করেই জাপানের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং জাপানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক নাগিসা ওশিমার দোভাষী হিসেবে বাংলাদেশে যাওয়ার অনুরোধ জানায়।
ওশিমা হচ্ছেন জগদ্বিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক, জাপানি ছায়াছবিতে নিউ ওয়েব বা নবতরঙ্গ ধারার প্রবর্তনে যাঁর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। টেলিভিশন চ্যানেলটি সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণের দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছিল এবং সে উপলক্ষে বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ওশিমা। তবে নিজের ভাষাগত পারদর্শিতার অভাবের কারণে ভালো ইংরেজি জানা একজন দোভাষীর প্রয়োজন তাঁর ছিল। সেই সূত্রে টেলিভিশন কোম্পানি সাতোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তোশিইয়ুকি সাতো অবশ্য কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছিলেন। দ্বিধা এ কারণে ছিল যে প্রথমত, ওশিমা হলেন জাপান এবং বিশ্বে পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করা তাঁর মতো একজন তরুণের পক্ষে সে রকম এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, প্রগতিবাদী হিসেবে জাপানি সমাজে স্বীকৃত সেই চলচ্চিত্র পরিচালকের চাহিদা পূরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে কি না, সেটাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে শেষ পর্যন্ত সব রকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে সেই কাজে জড়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন। জীবনে সম্পূর্ণ নতুন ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভের পথ সেই ভ্রমণ তাঁর সামনে খুলে দিয়েছিল।
বাংলাদেশের বিজয় তখন মাত্র এক বছর পূরণ করেছে। সদ্য স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি দেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর তখন কাটছিল ব্যস্ত সময়। যোগাযোগ জটিলতার কারণে ওশিমা ও তাঁর চলচ্চিত্র ইউনিট ঢাকা পৌঁছানোর আগে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টি ঠিক করে নিতে পারেনি। ফলে সাতোকে দিন দুয়েক আগে ঢাকায় এসে সেই ব্যবস্থা করে নিতে হয় এবং ঢাকার জাপানি দূতাবাসের সহায়তায় তিনি তা করতে পেরেছিলেন। নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী যথাসময়ে সাক্ষাৎকার শুরু হলে প্রগতিবাদী ওশিমা মুখোমুখি হয়েছিলেন উদার-মানবতাবাদী তৃতীয় বিশ্বের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। দুই বিশিষ্টজনের সেই সাক্ষাৎকারে বলা যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রভাব সহজেই ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন এবং ওশিমাকে তা মুগ্ধ করেছিল। খোলামেলা আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশের মানুষের জন্য খুব বেশি কিছু নয়, শুধু ডাল-ভাতের ব্যবস্থা শুরুতে তিনি করে দিতে চান। ডাল-ভাতের খাবার বলতে কী বোঝায় তা নিজের চোখে দেখে নেওয়ার জন্য পরদিন সকালে বাড়িতে প্রাতরাশের সময় ওশিমাকে সেখানে যাওয়ার অনুরোধ তিনি করেছিলেন। এক দিন পরের সেই প্রাতরাশের ধারণ করা ছবি আমরা ওশিমার প্রামাণ্য চিত্রে দেখতে পাই, ওশিমা সেখানে কোনো রকম রাখঢাক ছাড়া যে কথা বলেছেন তা হলো, বিশ্বের আর কোনো সরকারপ্রধান এতটা সাধারণ আহার করেন বলে তাঁর মনে হয় না।
তোশিইয়ুকি সাতো সেখানে দেখেছিলেন পুরো পরিবারকে একসঙ্গে প্রাতরাশ সেরে নিতে। সেখানে ছিল বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র রাসেল, একটু পরপর চলচ্চিত্র ক্রুদের কাছে এসে মনোযোগের সঙ্গে তাদের কাজ দেখছিল। তোশিইয়ুকি সাতো বেদনার সঙ্গে স্মরণ করেছেন ১৯৭৫ সালের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সেই রাসেলের কথা তাঁর মনে পড়ে যাওয়ার স্মৃতি। অসম্ভব প্রাণবন্ত সেই শিশুর মৃত্যুর ঘটনা গভীর দুঃখ দিয়েছিল তাঁকে।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার আগেই আরও এক বিস্ময় জাপানি দলের জন্য অপেক্ষা করছিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে, যেখানে তাঁরা গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পিতার সাক্ষাৎকার নিতে। নৌপথে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর গ্রামবাসী উৎসাহের সঙ্গে পুরো দলকে নিয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক নিবাসে, যেখানে গিয়ে সাতো অবাক হয়ে দেখেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রীর পিতা বসে আছেন টিনের চালার অতি সাধারণ এক ঘরে। পিতার কাছে পুত্রের কথা জানতে চেয়ে তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন শৈশব ও বাল্যকালে কেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পিতার এক বাক্যের জবাব, ‘সে ছিল ভালো ছেলে।’
পুত্রের কাছ থেকে পিতা এখন কী প্রত্যাশা করছেন, সেই প্রশ্নের উত্তরেও খুব সহজভাবে পিতা বলেছিলেন যে তিনি চাইছেন মূল দায়িত্ব পালনের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় পুত্র যেন সবকিছু ছেড়ে গ্রামে এসে তাঁর সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন। স্বল্পকালের সেই সাক্ষাৎকারে তোশিইয়ুকি সাতো সেদিন দেখেছিলেন এর আগে সাক্ষাৎ পাওয়া পুত্রের মতোই পিতার অসম্ভব সারল্য, যা তাঁকে সহজেই মুগ্ধ করেছিল। ওশিমার ছবিতে বঙ্গবন্ধুর জীবনের এ রকম নানা দিকের পরিচয় আমাদের সামনে ফুটে ওঠে, যেসব দিকের অনেকটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও বিদেশিদের চোখে তা ধরা দিয়েছে অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে। আর সে রকম এক ব্যক্তিত্বকে কাছ থেকে দেখে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলেন বলে তোশিইয়ুকি সাতো নিজেকে আজও ভাগ্যবান মনে করছেন।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।