ট্রাম্প যুগের অনিশ্চয়তা

জোসেফ ই স্টিগলিৎস
জোসেফ ই স্টিগলিৎস

তবে ২০১৬ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলি ঠিক সেভাবে পরিচালিত হয়নি। আমি অনেক দিন ধরেই লিখে আসছি, ক্রমবর্ধমান অসমতার ব্যাপারটি আমলে নেওয়া না হলে তার রাজনৈতিক পরিণতি দেখা যাবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু অসমতা ক্রমাগত বেড়েই গেল, আমাদের হাতে যেসব তথ্য-উপাত্ত এল তাতে ধাক্কা খেলাম, যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের গড় আয়ু কমেছে। গত বছর অ্যান কেস ও অ্যাঙ্গাস ডেটনের সমীক্ষায় এর আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক মানুষের গড় আয়ু কমছে।

কিন্তু সমাজের নিচুস্তরের মানুষের উপার্জন এক শতকের সিকি সময় ধরে স্থবির থাকায় স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, দেশের বিপুল অংশের মানুষের অবস্থা ভালো নয়। যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রবণতা সবচেয়ে মারাত্মক হলেও অন্য জায়গায় এর অবস্থা সামান্যই ভালো, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।

এই পরিস্থিতির রাজনৈতিক পরিণতি দেখা যাবে সেটা পরিষ্কার ছিল, কিন্তু তার স্থান ও কাল অতটা পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু কথা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি যখন উন্নতির পথে ছিল, তখনই কেন এই উল্টো প্রতিক্রিয়া হলো? আর এর বহিঃপ্রকাশই বা কেন ডান দিকে হেলে পড়ার মধ্য দিয়ে দেখা গেল? সর্বোপরি এই রিপাবলিকানরাই তো বিশ্বায়নের কারণে চাকরি হারানো মানুষদের সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। রিপাবলিকানরাই এই বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে। এই রিপাবলিকানরা ২৬টি রাজ্যে মেডিকেইডের বিস্তৃতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার মাধ্যমে সমাজের নিচুস্তরের মানুষেরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এর ফলে এমন একজন বিজয়ী হলেন, যিনি অন্যদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে আয়-রোজগার করেন। সেই ব্যক্তি আবার প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, তিনি কর ফাঁকি দেন, যিনি এটাকে গর্বের বিষয় মনে করেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সময়ের চেতনা ধারণ করতে পেরেছেন: পরিস্থিতি ঠিকঠাক যাচ্ছিল না, ফলে অনেক ভোটারই পরিবর্তন চাচ্ছিলেন। এখন তাঁরা সেটা পাবেন, স্বাভাবিক রীতিতে কোনো কিছু চলবে না। কিন্তু এ রকম অনিশ্চয়তা কদাচিৎ দেখা গেছে। কিন্তু ট্রাম্প কোন নীতি গ্রহণ করবেন, তা এখনো অজানা; যাতে বলা যায়, এর কোনোটিই সফল হবে না, তার পরিণতি যা-ই হোক না কেন।

মনে হচ্ছে, বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার জন্য ট্রাম্প নরকে যেতেও রাজি আছেন। কিন্তু চীন ও মেক্সিকো কীভাবে তাতে সাড়া দেবে? ট্রাম্প হয়তো বুঝবেন, তিনি যা প্রস্তাব করবেন তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম লঙ্ঘন করবে। কিন্তু ট্রাম্পের এটাও জানার কথা যে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনেক সময় লাগবে। আর তত দিনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য হিসাবে ভারসাম্য এসেও যেতে পারে।

কিন্তু দুটি শক্তি এই খেলা খেলতে পারে: চীন একই ব্যবস্থা নিতে পারে, যদিও তার প্রতিক্রিয়া সূক্ষ্মতর হওয়ার কথা। যদি বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে কী হবে? ট্রাম্প জিতে যাবেন, তাঁর এমনটা ভাবার কারণ আছে। সর্বোপরি, রপ্তানির জন্য চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর যতটা নির্ভরশীল, অন্য কারও ওপর ততটা নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। কিন্তু বাণিজ্যযুদ্ধে একজন যতটা জেতে, আরেকজন ততটা হারে না। এতে যুক্তরাষ্ট্রেরও হারানোর আশঙ্কা আছে। চীন হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে রাজনৈতিক ব্যথা দেওয়ার প্রতিশোধমূলক নীতিতে অধিক কার্যকর হবে। কথা হচ্ছে, পাল্টা জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে চীন যতটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে, যুক্তরাষ্ট্র ততটা সুবিধাজনক জায়গায় নেই। ধারণা করুন, কে এই যন্ত্রণাটা বেশি সহ্য করতে পারবে। এটা কি যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে আমজনতা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে; নাকি চীন, যারা সংকটময় সময় সত্ত্বেও ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে?

আরও বড় পরিসরে বলা যায়, রিপাবলিকান/ ট্রাম্প অ্যাজেন্ডা, যা কিনা ধনীদের পক্ষেই হেলে আছে, চুইয়ে পড়া নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এটা রিগ্যানের নীতির ধারাবাহিকতা মাত্র, যেটা আসলে কখনোই ঠিকঠাক কাজ করেনি। অনলবর্ষী বক্তৃতা ও রাত তিনটার সময় প্রলাপধর্মী টুইটের মাধ্যমে হয়তো রিগ্যান বিপ্লবে বাদ পড়া মানুষদের রাগ ক্ষণিকের জন্য প্রশমিত হবে, অন্তত কিছুদিনের জন্য। কিন্তু কত দিন? এরপর কী হবে?

ভুডু (ক্যারিবীয় অঞ্চলের অদ্ভুত ধর্মীয় আচার) অর্থনীতি চালু করতে গিয়ে ট্রাম্প হয়তো অর্থনীতির সাধারণ নিয়মগুলো বাতিল করতে চাইবেন। কিন্তু তিনি সেটা পারবেন না। এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭ সালে অনাবিষ্কৃত জলপথে নৌকা ভাসাতে যাচ্ছে। ফলে আমার মতো একজন নশ্বর মানুষের পক্ষে তার আভাস দেওয়ার চেষ্টা করা বোকামি; যে জলপথ নিশ্চিতভাবে অনিশ্চিত, যেখানে বহু পণ্ডিতের নৌকা ডুবে যাবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ  স্টিগলিৎস: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ