ট্রাম্পের ইউরোপ-ভাবনা

ইউরোপের ২৭টি দেশ এ বছর সাড়ম্বরে যখন ইউরোপীয় কমন মার্কেটের ৬০ বছর পূর্তি উৎসবের জন্য বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করতে যাচ্ছে, তখনই উৎসবের আমেজকে বিষাদ করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। ইউরোপের ভেতর থেকে আর আটলান্টিকের অপর পাড় থেকে ইউরোপীয় জোটকে নিয়ে নানা হুংকার আসছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি আর প্রতিবেশী দেশগুলোর জাতিগত অবিশ্বাসবোধকে পেছনে ফেলে ১৯৫৭ সালে ইউরোপের ছয় দেশ জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও হল্যান্ড নিজেদের পণ্য অবাধে বিনিময়ের জন্য রোম চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সেই থেকেই শুরু ইউরোপীয় ইউনিয়নের যাত্রা। আর বিগত ৬০ বছরে এই জোট বিশ্বের অন্যতম মহাদেশীয় জোট হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।
সদ্য নির্বাচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে নানা উক্তি ভাবনায় ফেলেছে ইউরোপকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিগত প্রায় ৭০ বছরের টানা বন্ধুত্ব আর মৈত্রীর সম্পর্কে হঠাৎ করেই সংকট দেখা দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৫ জানুয়ারি যৌথভাবে ইউরোপের দুটি পত্রিকা জার্মানির বিল্ড ও ব্রিটেনের দ্য টাইমসকে সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পের ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য, ইউরোপ-আমেরিকার ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে সংশয়ের মুখে ফেলেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই দুই পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ক্ষয়িষ্ণু জোট ও সময়ের বিবর্তনে তা ভেঙে পড়বে বলে অভিহিত করে ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের মতো আরও দেশ জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জার্মানির স্বার্থের বাহন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ন্যাটো সামরিক জোটকেও পুরোনো ও অচল বলে আখ্যায়িত করেছেন। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতির সমালোচনা করে তাকে সর্বনাশা ও ভুল সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন।
বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব মন্তব্য নিয়ে ইউরোপে নানা রকম বিতর্ক হচ্ছে, মাত্র দুই মাস আগে ইউরোপ সফরের সময় ট্রাম্পের পূর্বসূরি বারাক ওবামা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন এটি ইউরোপের একটি ঐতিহাসিক জোট এবং ইউরোপের সব মানুষের দায়িত্ব এই জোটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর এখন তাঁরই উত্তরসূরির এসব লাগামহীন মন্তব্যে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পরের দিনই জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে যথেষ্ট সজাগ ও সমস্যা সমাধানে নিজেরাই পারদর্শী। তিনি সন্ত্রাস ও যুদ্ধকবলিত দেশগুলো থেকে বাঁচতে শরণার্থীদের আগমনের বিষয়টিকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথা বলেন এবং তাঁর শরণার্থী নীতি যে মানবিক কারণে গৃহীত হয়েছে, তা পুনর্ব্যক্ত করেন।
আঙ্গেলা ম্যার্কেল ১২ জানুয়ারি বেলজিয়ামের দুটি সুবিখ্যাত গেন্ট ও লুয়েভেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘শরণার্থীদের বিপর্যয় ও সংকটের মুখে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইউরোপীয় রাজনৈতিক শক্তিকে আরও বিকশিত করার প্রচেষ্টা’-এর জন্য ডক্টরেট উপাধি গ্রহণ করেন। ব্রাসেলসের সেই অনুষ্ঠানে ইউরোপ ও বিশ্ব রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীগুলোকে আরও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তা ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকান সম্পর্ক যে চিরন্তন নয়, তা-ও স্মরণ করেন এবং সে ক্ষেত্রে ইউরোপের সমস্যা ও সমাধানের ব্যাপারে নিজেদের উদ্যোগ ও সক্ষমতার কথা বলেন।

>দীর্ঘদিনের বন্ধু ও মিত্র আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউরোপকে নিয়ে অকূটনৈতিকসুলভ মন্তব্য করলেও ইউরোপীয় নেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। একজন ধনাঢ্য পুঁজিপতি ব্যবসায়ী যখন রাষ্ট্রের কর্ণধার হবেন, তখন রাষ্ট্রের পুঁজির ব্যাপারটাই মুখ্য হয়ে উঠবে

এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সাক্ষাৎকারে ন্যাটো ও যুক্তরাজ্যের ইইউ ছেড়ে যাওয়া, জার্মানির তৈরি গাড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে অধিক শুল্ক নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তাতে বিস্ময় প্রকাশ করে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার বলেছেন, বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক চুক্তি ও নিয়মনীতি রয়েছে, তাই হঠাৎ করেই নিজেদের ভাবনা বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আর যুক্তরাজ্য ইইউ চুক্তি অনুযায়ী শরণার্থীদের নিতে বাধ্য হতে হচ্ছিল বলেই ইইউ ছেড়ে গেছে, ট্রাম্পের এই যুক্তিটিও অসাড়।
প্রকৃত সত্যটি হলো, ২০১৫ সালে ইউরোপ অভিমুখে যখন শরণার্থীদের ঢল নেমেছিল, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন সেই সময় ২০ হাজার শরণার্থী গ্রহণ করার কথা বললেও পরে তিনি তার অর্ধেকেরও কম শরণার্থী গ্রহণ করেছিলেন।
২০১৫ সালের ৩০ আগস্ট লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রখ্যাত সাংবাদিক ইউল হুটন লিখেছিলেন, ‘আমাদের সবাইকে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের কাছে মানবিকতার শিক্ষা নিতে হবে।’ অভিবাসীদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের এ ধরনের আচরণ লজ্জাজনক ও জার্মানির তুলনায় এ বছর আমাদের এখানে আসা অভিবাসীর সংখ্যা অতি নগণ্য বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। উল্লেখ্য, এ বছর ওই সময় পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে ১০ হাজারের কম শরণার্থী প্রবেশ করতে পেরেছিল। দ্য গার্ডিয়ান-এর আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক টিমোথি গার্টেনও গত বছরের ১১ নভেম্বর লিখেছেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় যে পপুলিজম রাজনীতির স্রোত বইছে, তার বিপরীতে ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বের মূল্যবোধ ধরে রাখতে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের বিকল্প নেই।
সদ্য নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমস্যা হলো, ইতিহাস পাঠ বা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার অক্ষমতা। ইউরোপ ও আমেরিকার ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন অতীত রয়েছে, গত শতাব্দীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ করে ইউরোপের যে মানবিক শিক্ষা হয়েছে, তার হাত ধরেই ইউরোপীয় ২৮ জাতিগোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্টতা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করেছে। আর আমেরিকা নানা দেশে যুদ্ধ সংগঠিত ও সহযোগিতা করলেও নিজ দেশে কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাদের নেই।
সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ৪৭তম ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎজ জার্মানির স্পিগেল সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার সমালোচনা করে বলেছেন, ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা মহাদেশীয় রাজনীতির থেকে অর্থনৈতিক বিষয়টি বেশি করে দেখছেন। আর একইভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচিকে ভণ্ডামির নতুন মাত্রা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক চুক্তিগুলোর যে আইনি কাঠামো রয়েছে, তা হঠাৎ করেই লঙ্ঘন করা যায় না। তিনি ইউরোপীয় রাজনীতিকদের নিজ নিজ দেশের অসন্তুষ্ট জনগণের সঙ্গে কথা বলা ও তাদের মতামত গ্রহণ করার কথাও বলেছেন।
বিগত কয়েক দশকের মধ্যে ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি সংকটময় অবস্থায় রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে শরণার্থীদের অব্যাহত আগমন, যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগ, বিভিন্ন শহরে সন্ত্রাসী হামলা, পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে ডানপন্থীদের উত্থান, পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ ও রাশিয়ার সঙ্গে টানাপোড়েন ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এই সংকটের মুখে ফেলেছে। জার্মানির কোবলেঞ্জ শহরে ২১ জানুয়ারি বর্ণবাদ, অভিবাসী ও ইসলামবিদ্বেষী দল হিসেবে পরিচিত কট্টরবাদী দলগুলো ‘ইউরোপের মুক্তি’ শীর্ষক এক সম্মেলনে ২০১৭ সালকে ইউরোপীয় দেশপ্রেমিকদের উত্থানের বছর বলে ঘোষণা দিয়েছে। সম্মেলনে ছয়টি দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে স্বৈরশাসক এবং ইউরোপীয় স্বকীয়তা ও সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার চেষ্টাসহ ইউরোপীয় জনগণকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। এখন ইউরোপের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী সামাজিক গণতন্ত্রী, খ্রিষ্টান গণতন্ত্রী, বাম দলগুলো ও পরিবেশবাদী দলগুলো নিজেদের মতপার্থক্য পাশে রেখে একযোগে এই সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে।
দীর্ঘদিনের বন্ধু ও মিত্র আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইউরোপকে নিয়ে অকূটনৈতিকসুলভ মন্তব্য করলেও ইউরোপীয় নেতারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। একজন ধনাঢ্য পুঁজিপতি ব্যবসায়ী যখন রাষ্ট্রের কর্ণধার হবেন, তখন রাষ্ট্রের পুঁজির ব্যাপারটাই মুখ্য হয়ে উঠবে, সে ক্ষেত্রে মানবিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, জোট ও বিশ্বায়নের বিষয়গুলো হয়তো তাঁর কাছে গৌণ হয়ে উঠবে। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতি থেকে সরে রক্ষণশীল অর্থনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে ট্রাম্পের নতুন ইউরোপ-ভাবনা আমেরিকাকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা দেখতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]