ট্রাম্পের উত্থানের কারণ কী?

জোসেফ ই স্টিগলিৎস
জোসেফ ই স্টিগলিৎস

সম্প্রতি বিশ্বের যেখানেই সফর করতে গিয়েছি, সেখানেই আমাকে বারবার দুটি প্রশ্ন করা হয়েছে—ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হবেন, ব্যাপারটা কি কল্পনাসাধ্য? আর তিনি এত দূর এলেনই বা কীভাবে?
অর্থনৈতিক পূর্বাভাস রাজনৈতিক পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক কঠিন, বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, সব লক্ষণই এখন পর্যন্ত হিলারি ক্লিনটনের অনুকূলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই প্রতিযোগিতায় কীভাবে এত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে, তা সত্যিই এক বিস্ময়! কথা হচ্ছে হিলারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে যোগ্য ও প্রস্তুত প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে একজন। অন্যদিকে ট্রাম্প সবচেয়ে অযোগ্য ও অপ্রস্তুত প্রার্থীদের একজন। তা ছাড়া, ট্রাম্পের এত কুকথা ও কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও তিনি নির্বাচনের দৌড়ে এত দূর আসতে পেরেছেন, অতীতকালে অন্য কেউ এ কাজ করলে তাঁর সম্ভাবনা আগেই শেষ হয়ে যেত।
তাই মার্কিনদের রুশি রুলেট (জুয়া) খেলার কী দরকার? (ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা ছয় ভাগের এক ভাগ) যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের মানুষেরা এর উত্তর জানতে চায়। কারণ, দেশটির নির্বাচনের ফলাফলের জন্য তাদেরও ভুগতে হয়। যদিও এতে তাদের কোনো প্রভাব নেই। এবার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসি। রিপাবলিকান পার্টি ট্রাম্পের মতো একজন প্রার্থীকে কেন মনোনয়ন দিল? যেখানে দলটির নেতারাই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

দৃশ্যত নানা কারণেই ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির ১৬ জন প্রার্থীকে হারাতে পেরেছেন। ব্যক্তিত্বেরও ব্যাপার আছে। মনে হয়েছে কিছু মানুষ তাঁর টিভি রিয়েলিটি শোর ব্যক্তিত্বকে পছন্দ করে ফেলেছিল। আবার এই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কিছু অন্তর্নিহিত কারণও আছে। প্রথমত বলতে হয়, অনেক মার্কিনের অর্থনৈতিক অবস্থা আজ থেকে ২৫ বছর আগের তুলনায় খারাপ। পূর্ণকালীন চাকরিজীবীদের গড় আয় ৪২ বছর আগের তুলনায় কম। আর শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক দিয়ে যারা মাঝারি গোছের, তাদের পক্ষে ভালো বেতনের চাকরি পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

বস্তুত, সমাজের একদম নিচের স্তরের মানুষের প্রকৃত মজুরি (মূল্যস্ফীতি-সমন্বিত) এখনো ৬০ বছর আগের পর্যায়ে পড়ে আছে। এর ফলে ট্রাম্প যখন বলেন, মার্কিন দেশের অর্থনীতি পচে গেছে, তখন যে তিনি সমর্থন পাবেন, তাতে বিস্ময়ের কী আছে। কিন্তু তাঁর রোগনির্ণয় ও পরামর্শপত্র উভয়ই ভুল। কারণ, সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতি গত ৬০ বছরে ভালোই করেছে। মোট দেশজ উৎপাদন প্রায় ছয় গুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির সুফল খুব কম মানুষের ঘরেই গেছে। ট্রাম্পের মতো কিছু মানুষ সেটা ভোগ করছেন। যার কারণ হচ্ছে বিপুল হারে কর হ্রাস। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে যেটা আরও কমবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতারা বাণিজ্য ও আর্থিক খাতে যে সংস্কারের অঙ্গীকার করেছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবতা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওসব থেকে অনেক দূরে। এর ফলে যাদের জীবনমান থমকে গেছে বা তার অবনমন ঘটেছে, তারা একটি সাধারণ উপসংহারে পৌঁছেছে। মার্কিন রাজনৈতিক নেতারা হয় জানেন না তাঁরা কী বলছেন, অথবা তাঁরা মিথ্যা বলছেন (অথবা উভয়ই)।

ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব সমস্যাই বাণিজ্য ও অভিবাসনের ঘাড়ে চাপাতে চান, এটা ঠিক নয়। মুক্তবাণিজ্য না থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প বন্ধ হয়ে যেত। কারণ, সারা পৃথিবীতেই উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান কমছে, যেখানে চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে। আর বাণিজ্য চুক্তি ব্যর্থ হচ্ছে তার কারণ কিন্তু এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যদের সঙ্গে পেরে উঠছে না। এর কারণ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের সূচি নির্ধারিত হয় করপোরেট স্বার্থ দ্বারা। মার্কিন কোম্পানিগুলো ভালো করেছে। আর যে মার্কিনরা বাণিজ্য চুক্তির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা যাতে সুফলের ভাগ না পান তা নিশ্চিত করেছেন রিপাবলিকানরাই।

এর ফলে অনেক মার্কিন নাগরিকই এমন শক্তির হাতে চপেটাঘাত খাচ্ছেন, যে শক্তি তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এতে যে ফলাফল সৃষ্টি হয় তা খুবই অন্যায্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আগের যে ধারণা ছিল—এটি সুযোগ সন্ধানের দেশ। আর প্রতিটি প্রজন্ম আগের প্রজন্ম থেকে ভালো থাকবে, সে ধারণা এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক আর্থিক সংকট অনেক ভোটারের জীবন বদলে দিয়েছে। এরপর তারা দেখল, সরকার সেই ধনী ব্যাংকারদের রক্ষা করল, যারা দেশটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। অথচ যে মানুষেরা বাড়িঘর ও চাকরি হারাল, সরকার দৃশ্যত তাদের জন্য কিছুই করল না। এই ব্যবস্থার কারণে শুধু যে অন্যায্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো তা নয়, মনে হলো, ব্যবস্থাটাই এত দুর্নীতিপরায়ণ যে তার কাজই হচ্ছে এসব করা।

আসলে সরকারের ওপর মানুষের যে ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাই হচ্ছে ট্রাম্পের সমর্থনের ভিত্তি। কিন্তু ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নীতির কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কারণ, তাঁর নীতিও তো ধনী তোষণমূলক। কথা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি চীন, মেক্সিকো ও অন্য ব্যবসায়ী সহযোগীদের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ লাগাতে চায়, তাহলে মার্কিনরা আরও গরিব হবে। আর বৈশ্বিক সহযোগিতার পথে তা আরও বাধা সৃষ্টি করবে। অথচ ইসলামিক স্টেটসহ বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার জন্য এই সহযোগিতা অপরিহার্য।

এখানে দুটি বার্তা রয়েছে, যাতে মার্কিন রাজনৈতিক অভিজাতদের কান দিতে হবে। গত চার দশকে যে নব্য উদারনীতিবাদী বাজারকেন্দ্রিক তত্ত্ব অনুসরণ করা হয়েছে, তা আমাদের ভুল পথে নিয়ে গেছে। হ্যাঁ, এতে জিডিপির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের বিনিময়ে। চুইয়ে পড়া অর্থনৈতিক তত্ত্ব কাজে আসেনি, ভবিষ্যতেও আসবে না। শূন্যতার মধ্যে বাজার টিকে থাকতে পারে না। থ্যাচার-রিগ্যানের এই নব্য উদারনীতিবাদী বিপ্লব ওপরের তলার মানুষদের ধনী বানিয়েছে, তার সঙ্গে বাড়িয়েছে বৈষম্য। কিন্তু এটি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে।

এখান থেকেই আমরা দ্বিতীয় বার্তাটি পাই—আবারও অর্থনীতির সূত্র পুনর্লিখন করতে হবে। তবে এবার সাধারণ মানুষের মঙ্গল নিশ্চিত করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা এটা অগ্রাহ্য করবেন, তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে। পরিবর্তনের সঙ্গে ঝুঁকিও থাকে। কিন্তু ট্রাম্পের এই উত্থানের ঘটনায় বোঝা যাচ্ছে, এই বার্তা আমলে নিতে ব্যর্থ হলে আমাদের আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ