ট্রাম্পের দঙ্গল বিষয়ে আসল সত্য

ডোনাল্ড ট্রাম্প

৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে ঘটা তাণ্ডবকে সহজেই ভুল বোঝা হচ্ছে। পরিস্থিতির ধাক্কায় মার্কিন কংগ্রেস বিবৃতি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছে যে আমেরিকা উচ্ছৃঙ্খল জনতার নয়, বরং আইন মান্যকারীদের দেশ। বোঝানো হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানিতে যা ঘটেছে, তা যেন নতুন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের সেবায় নিয়োজিত শ্বেতাঙ্গ রাজনীতিবিদদের ইন্ধনে ঘটা দীর্ঘ গণহিংসার ইতিহাস। কালোরা এসব করেনি, বরং তারাই ছিল এসবের শিকার।

এ দাঙ্গা-হাঙ্গামার বাস্তবতা আসলেই মারাত্মক। এর উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেসকে ভয় দেখিয়ে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর বন্ধ করা। এটা রাষ্ট্রদ্রোহ এবং এতে ইন্ধন জুগিয়ে ট্রাম্প গুরুতর অপরাধ করেছেন।

অতীতে এ ধরনের গণসহিংসতার লক্ষ্য হয়ে থাকত শ্বেতাঙ্গদের ঘৃণার চিরাচরিত লক্ষ্যবস্তুরা: যেমন আফ্রিকান আমেরিকানরা যখন ভোট দিতে চেয়েছে বা বাসে আলাদা আসনে বসতে চায়নি; তারা শিকার হয়েছে খাবারের কাউন্টারে, স্কুলে; আদিবাসী আমেরিকানরা যখন তাদের পশু শিকারের ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচাতে গেছে; মেক্সিকান খামারশ্রমিকেরা যখন পেশাগত সুরক্ষা চেয়েছে কিংবা অভিবাসী চীনা শ্রমিকেরা যারা অতীতে রেললাইন ও খনি নির্মাণ করেছে। এসব গোষ্ঠীর মানুষ গণসহিংসতার শিকার হয়েছে প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের সময়ে এবং উনিশ শতকে কিট কারসন কিংবা বিশ শতকে আলাবামার গভর্নর জর্জ ওয়ালেসের দ্বারা।

সংগত কারণেই তরুণ আমেরিকানরা অতীতের প্রজন্মগুলোর চেয়ে বর্ণবাদ বিষয়ে বেশি সজাগ। ক্যাপিটলে উন্মোচিত হওয়া ট্রাম্পীয় নোংরামি হয়তো উদ্বেগজনক। কিন্তু একে দেখা উচিত মরিয়া ও করুণ শেষ চেষ্টা হিসেবে। সৌভাগ্যজনকভাবে আমেরিকার শ্বেতবর্ণবাদী দাপট ইতিহাসে বিলীন হচ্ছে, যদিও খুব ধীরগতিতে

ইতিহাসের আলোকে দেখলে ক্যাপিটলে হামলাকারীরা অতিপরিচিত। দাঙ্গা শুরু করার জন্য ট্রাম্প যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানেও বলা হয়েছে, ওরা বের হয়েছে আমেরিকাকে ‘বাঁচাতে’। ‘দুর্বলেরা বিদায় হোক। এটা শক্তি দেখানোর সময়’ তিনি ঘোষণা করেছেন, ছড়িয়েছেন পরিচিত ঘৃণার সুর।

আমেরিকার ইতিহাসজুড়ে বেশির ভাগ গণসহিংসতা নিচুতলা থেকে উঠে আসা স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ হিসেবে ঘটেনি, বরং ঘটেছে ওপরতলা থেকে চালানো পরিকল্পিত সন্ত্রাস হিসেবে। দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের ভয়, ঘৃণা ও আহাম্মকিকে কাজে লাগিয়ে তাদের উসকে দিয়েছে শ্বেতাঙ্গ রাজনীতিকেরা। দেড় শ বছর ধরে শ্বেতাঙ্গ উচ্চশ্রেণির লোকেরা তাদের সুবিধাবাদকে বাঁচাতে এসব করেছে।

আমেরিকার শ্বেত-সন্ত্রাসের সংস্কৃতি বন্দুকের সংস্কৃতির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলেছে। শ্বেতাঙ্গদের হাতে অসমভাবে রয়েছে লাখো আগ্নেয়াস্ত্র। কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী আমেরিকানদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে এই ‘বন্দুকের অধিকার’ চালু রাখা হয়েছে।

এভাবেই ধনী শ্বেতাঙ্গরা দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের হতাশাকে কালোদের বিরুদ্ধে চালিত করেছে। এটা আলাদা করে ট্রাম্পের কৌশল তো নয়ই, এটা আমেরিকান রাজনৈতিক চালচলনের খুব পুরোনো কৌশল। ধনীদের কর মওকুফের বিল পাস করাবেন, শুধু দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের বললেই হবে যে কালো ও মুসলিমরা ‘সমাজতন্ত্র’ কায়েম করতে আসছে।

ট্রাম্প তাঁর আমলজুড়ে এসবই করে এসেছেন। ভয় দেখিয়েছেন, তিনি পদে না থাকলে আমেরিকানদের ‘চীনা ভাষা শিখতে হবে’। প্রতিটি সভায় তিনি অশ্বেতাঙ্গ কংগ্রেস উইমেনদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করেছেন। তিনি তাঁর সমর্থকদের বিরোধীদের নাজেহাল করতে বলেছেন, বলেছেন তাদের দেশের বাইরে ছুড়ে ফেলে দিতে। শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের তিনি বলেছেন ‘অতি সজ্জন লোক’। ক্যাপিটল হিলে হামলাকারীদের তিনি বলেছেন, ‘আমরা তোমাদের ভালোবাসি, তোমরা আমার কাছে বিশেষ আদরের।’

রিপাবলিকান পার্টিও ৬ জানুয়ারির আগে অবধি ট্রাম্পকে পূর্ণ মদদ দিয়ে গেছে। কিন্তু রিপাবলিকানরা পার্টির তৃণমূলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার জন্য তাঁর প্রতি অনুগত ছিলেন না। ট্রাম্প আমেরিকান ডানপন্থার প্রতিভূ। তাঁর কাজকর্মও সব সময় পরিষ্কারই ছিল: বিচার বিভাগকে অথর্ব করে রাখা, ধনী ও করপোরেশনগুলোর কর মওকুফ করা, পরিবেশের সুরক্ষা ও সামাজিক খাতে খরচ বাড়ানোর দাবি ঠেকিয়ে রাখা, আর জনতাকে সমাজতন্ত্রের জুজুর ভয় দেখানো।

বারাক ওবামা দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তারপর ট্রাম্প নির্বাচিত হন তাঁর প্রতিপক্ষের চেয়ে কম ভোট পেয়ে। ইতিহাসের লীলায় আমেরিকা আবার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। আমেরিকা ক্রমে শ্বেত অভিজাত চক্রের শাসনের বাইরে চলে যাচ্ছে। ২০৪৫ সাল নাগাদ অ-হিস্পানিকেরা জনসংখ্যার অর্ধেকে পরিণত হবে, যেখানে ১৯৭০ সালে তারা ছিল ৮৩ শতাংশ। ২০৪৫ সালের পর আমেরিকা সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর দেশে পরিণত হবে। আর অ-হিস্পানিক শ্বেতাঙ্গরা হবে জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ।

সংগত কারণেই তরুণ আমেরিকানরা অতীতের প্রজন্মগুলোর চেয়ে বর্ণবাদ বিষয়ে বেশি সজাগ। ক্যাপিটলে উন্মোচিত হওয়া ট্রাম্পীয় নোংরামি হয়তো উদ্বেগজনক। কিন্তু একে দেখা উচিত মরিয়া ও করুণ শেষ চেষ্টা হিসেবে। সৌভাগ্যজনকভাবে আমেরিকার শ্বেত বর্ণবাদী দাপট ইতিহাসে বিলীন হচ্ছে, যদিও খুব ধীরগতিতে।


জেফরি ডি স্যাক্স কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক