ট্রাম্পের পর ‘খুদে ট্রাম্পরা’ এখন দিশেহারা

ডোনল্ড ট্রাম্প
ছবি; রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী জনতুষ্টিবাদী সরকারগুলো ধাক্কা খেয়েছে। এ কথা সত্য, রাশিয়া, ব্রাজিল ও তুরস্কের মতো যেসব দেশকে অন্য দেশের ওপর ততটা নির্ভর করতে হয় না, সেসব দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার ট্রাম্পের হেরে যাওয়া দেখে বিচলিত হয়নি। কিন্তু পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার মতো দেশের সরকারের জন্য ট্রাম্পের পতন বিপর্যয় হিসেবে নেমে এসেছে। এমনকি যদি বলা হয় যুক্তরাজ্যের বরিস জনসনের সরকারও এই দলে আছে, তাহলেও হয়তো অত্যুক্তি হয় না।

জো বাইডেনের জয়কে এসব ছোট ছোট ডানপন্থী শক্তি ভীতিকর এবং বিরক্তিকর হিসেবে দেখেছে। বাইডেনের জয়ে সবচেয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার হুচিচ। তিনি বলেছেন, ‘বাইডেন যখন সার্বিয়ায় এসেছিলেন (বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে) তখন তাঁর সঙ্গে আমি কথাই বলিনি। এখনো তাঁর সঙ্গে আমার মিলবে না। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁকে অভিনন্দন জানানো দরকার, তাই জানালাম। কিন্তু ওই পর্যন্তই!’

এটি স্পষ্ট, হুচিচের নির্বাচনী আইডল হলো রাশিয়া, কখনোই আমেরিকা নয়।

হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ওরবান দীর্ঘদিন ধরেই তাঁর কথাবার্তা ও কাজকর্মের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার করেছেন, তাঁর ‘প্ল্যান এ’ ছিল ট্রাম্পের বিজয়ের কথা মাথায় রেখে। ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত হলে কীভাবে তাঁর সরকার ট্রাম্প সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও নিবিড় করবে, সেটাই ছিল তাঁর প্রাথমিক চিন্তা।

সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হুচিচের মতোই হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী পিতর জিজার্তোর যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক সরকারের প্রতি বিদ্বেষ আছে। ওবামার আমলে পিতর জিজার্তো বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাজই হলো সারাক্ষণ হাঙ্গেরিকে বক্তৃতা শোনানো, হাঙ্গেরির দোষ খোঁজা এবং দেশটিকে আক্রমণ করা।’

লক্ষ করার বিষয় হলো ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে বাস্তবিকই ভিক্তর ওরবান ওয়াশিংটন ডিসিতে অবাঞ্ছিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ যে প্রেসিডেন্ট হাঙ্গেরি সফর করেছেন, তিনি হলেন জর্জ বুশ। সময়টা ২০০৬ সাল। ওই সময় ওরবান ক্ষমতার বাইরে ছিলেন। ওরবান ২০১০ সালে গদিতে বসার পর সে সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বারবার ওরবান ও তাঁর সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের কড়া সমালোচনা করেছেন। এর জবাবে হাঙ্গেরি সরকার বেশ কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এবং হাঙ্গেরিতে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা বন্ধ করে দিয়েছিল।

তবে ওরবান বেশ কয়েকটি ভূরাজনৈতিক বল চালাচালি করে নিজের ক্ষমতা সংহত করতে চেয়েছিলেন। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছিলেন। এমনকি চীনকেও নিজের পক্ষে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। এ ছাড়া জার্মানির দিক থেকেও তিনি সুরক্ষা পেয়েছিলেন। ট্রাম্প এসব শক্তির জোরে ওরবান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মৌলিক নীতি ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করেছেন।

রাশিয়া, ব্রাজিল ও তুরস্কের মতো যেসব দেশকে অন্য দেশের ওপর ততটা নির্ভর করতে হয় না, সেসব দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার ট্রাম্পের হেরে যাওয়া দেখে বিচলিত হয়নি। কিন্তু পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার মতো দেশের সরকারের জন্য ট্রাম্পের পতন বিপর্যয় হিসেবে নেমে এসেছে। এমনকি যদি বলা হয় যুক্তরাজ্যের বরিস জনসনের সরকারও এই দলে আছে, তাহলেও হয়তো অত্যুক্তি হয় না

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাইডেনের জয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছে পোল্যান্ডের সরকার। ২০১৫ সালে যখন ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ক্ষমতায় আসে, তখন দলটি ইইউর মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে যুক্তরাজ্যকে পেয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে ট্রাম্পের জয়ের পর দলটি যুক্তরাষ্ট্রের মন জয়ে সবকিছু বাজি রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসনও তাদের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে।

এখন ট্রাম্প নেই। অন্যদিকে ‘ব্রিটেনের ট্রাম্প’ বলে অনেকের কাছে পরিচিত বরিস জনসনও বাইডেনের দিকে ঝুঁকেছেন। আর আগে থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল পোল্যান্ড সরকারের। ফলে পোল্যান্ডের ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সরকার এখন একা হয়ে পড়েছে।

বাইডেনের কালোতালিকায় আছে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ও বেলারুশ। তিনি সরকার গঠনের পরই এসব দেশ বেকায়দায় পড়তে শুরু করবে বলে অনেকেই মনে করেন।

এ বছরের গোড়ায় ইউরোপিয়ান কাউন্সিল এবং ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে ইইউভুক্ত দেশগুলোকে ইইউ তহবিলের সহায়তা পেতে হলে ইইউর যাবতীয় নীতি মানার শর্ত পূরণ করতে হবে। তা পূরণে ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল এখন কোনো সিদ্ধান্তমূলক ভোট দেওয়ার ক্ষমতা পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত আরোপের দিকে যাচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে পোল্যান্ডের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আর থাকছে না। ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকলে তাঁর যে সমর্থন পাওয়া যেত, এখন আর তা পাওয়া যাবে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

স্লাভমির সিয়েরাকভস্কি ওয়ারশতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের পরিচালক