ট্রাম্পের ভুয়া ভাষণ!

রবার্ট ফিস্ক
রবার্ট ফিস্ক

‘ভুয়া খবর’ উদ্ভাবনের পর যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট গত রোববার মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে ভুয়া ভাষণ দিলেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ভাষণ দেওয়ার জন্য সৌদি আরবে যাননি। কিন্তু এরপর তিনি ইসলামের প্রচারকদের সবক দিলেন, তাঁদের কী বলা উচিত।এখানেই শেষ নয়, তিনি এমনভাবে ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদের’ নিন্দা করলেন যে মনে হয়, সহিংসতা শুধু মুসলমানেরাই করে থাকেন। তারপর বাইবেলের আদি গ্রন্থে বর্ণিত নবীর মতো ঘোষণা দিলেন, তিনি ‘শুভ ও অশুভের দ্বন্দ্বের’ মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু গত বছর মুসলিমবিরোধী বর্ণবাদী বক্তৃতার জন্য তিনি একবারও দুঃখ প্রকাশ করলেন না।

আরও অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে, ‘গোষ্ঠীগত সহিংসতা উসকে দেওয়ার’ জন্য তিনি আইএসকে দোষারোপ না করে ইরানের ঘাড়ে দোষ চাপালেন। অথচ তার এক দিন আগেই ইরানি জনগণ স্বাধীনভাবে একজন উদার সংস্কারককে তাঁদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন। এরপর তিনি দাবি করলেন, বিশ্বের বৃহত্তম শিয়া-অধ্যুষিত দেশকে মধ্যপ্রাচ্যে একঘরে করে দিতে হবে। ভাবখানা এমন, এই অঞ্চলে ‘এত বেশি অস্থিতিশীলতার’ জন্য ইরানই দায়ী। শিয়া হিজবুল্লাহদের সমালোচনা করেছেন তিনি। একইভাবে ইয়েমেনি শিয়াদেরও। ফলে ট্রাম্পের এমন প্রজ্ঞা দেখে তাঁর সৌদি আতিথ্যকর্তারা উষ্ণতায় অবগাহন করেছেন।

সিএনএন এটাকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ‘শাণ দেওয়া’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ‘শাণ দেওয়ার’ জায়গায় ‘সারাই’ পড়ুন। কিন্তু রোববার রিয়াদে ট্রাম্পের এই তীব্র ভর্ৎসনা না ছিল ‘শাণ দেওয়া’, না ছিল ‘সংস্কার’। এটা ভাষণ, যদিও তিনি দাবি করেছেন, ভাষণ দিতে তিনি রিয়াদে যাননি।

তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা নিরপরাধ মানুষকে মেরে প্রতিবার যখন ভ্রান্তভাবে ঈশ্বরের নাম নেয়, তখন সেটা অবশ্যই বিশ্বাসী মানুষের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো।’ তবে তিনি এই ব্যাপারটা একেবারেই এড়িয়ে যান যে ইরান নয়, সৌদি আরবই ওয়াহাবি সালাফি চরমপন্থার কুলগুরু, যে ওয়াহাবি ‘সন্ত্রাসীরা’ ‘নিরপরাধ মানুষকে’ হত্যা করে। নিজের পুরোনো বর্ণবাদী ‘র‍্যাডিক্যাল ইসলামিক এক্সট্রিমিস্ট’ (আমূল সংস্কারকামী ইসলামি চরমপন্থী) মন্ত্র বাদ দিয়ে তার জায়গায় ‘ইসলামপন্থী চরমপন্থী’ ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি দৃশ্যত শব্দ ব্যবহারে ভুল করেছেন। তিনি ‘ইসলামি’ শব্দটি বলেছেন। ইংরেজি শব্দের ব্যবহারে সূক্ষ্ম পার্থক্য আনার চেষ্টা করেছেন তিনি একটি ব্যাপারে বৈচিত্র্য আনার জন্য, আর সেটা হলো—সন্ত্রাসীরা মুসলমান।

তবে এসবই তিনি করেছেন সৌদি আরবের সঙ্গে নির্লজ্জভাবে ১১ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র চুক্তি এবং কাতারের সামরিক সরঞ্জাম কেনার প্রস্তাবের পর। কাতারের প্রস্তাব সম্পর্কে ট্রাম্প অশ্লীলভাবে বলেছেন: ‘প্রচুর পরিমাণ সুন্দর সামরিক সরঞ্জাম’। ব্যাপারটা প্রায় চমকপ্রদই, তিনি পোপের সঙ্গে সাক্ষাতের দুদিন আগে এ কথাটি বললেন। কারণ, পোপ দুই সপ্তাহ আগে কায়রোতে অস্ত্র ব্যবসায়ীদের গালাগাল করেছেন।

ট্রাম্প সৌদিসহ ৫০টি মুসলিম দেশের নেতাদের সামনে রোববার বলেছেন, ‘আমরা নীতিভিত্তিক বাস্তববাদ গ্রহণ করতে যাচ্ছি, যার মূল সাধারণ মূল্যবোধ ও অভিন্ন স্বার্থের মধ্যে নিহিত।’ কিন্তু কী সেই মূল্যবোধ? অস্ত্র আর তেল বিক্রি ছাড়া এই অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোন মূল্যবোধের মিল আছে?

আর ট্রাম্প যখন বলেন, ‘আমাদের বন্ধুরা কখনোই আমাদের সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন করবে না, বা আমাদের শত্রুরা কখনোই আমাদের সংকল্প নিয়ে সন্দেহ করবে না।’ তখন কি সৌদি আরবের তাঁর বন্ধু হওয়ার কথা ছিল? বা ‘ইসলামি জাহানের’ কি তাঁর বন্ধু হওয়ার কথা, যে তালিকায় অবশ্যই ইরান, সিরিয়া ও ইয়েমেনের থাকার কথা। লিবিয়ার যুদ্ধরত রক্ষীবাহিনীর কি তাঁর বন্ধু হওয়ার কথা? আর শত্রুদের কথা যখন তিনি বলেন, তখন কি তিনি আইএসের কথা মাথায় রাখেন? অথবা রাশিয়া, সিরিয়া বা ইরানের কথা? ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখতে চান। নাকি তিনি সুন্নি মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখে শিয়াদের সঙ্গে শত্রুতা বজায় রাখছেন?

শেষ বিচারে রিয়াদে তাঁর বক্তৃতার মাজেজাই ছিল এটি। এই ছোট উদ্ধৃতিটি মনে রাখুন: ‘আমরা বর্তমান বাস্তব জগতের পরিণতির সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেব, অনমনীয় আদর্শের ভিত্তিতে নয়। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা পরিচালিত হব, বাঁধাধরা চিন্তার নিগড়ে আটকে থাকব না। আর যেখানেই সম্ভব, সেখানে আমরা ক্রমান্বয়ে সংস্কার আনব। হঠাৎ করে হস্তক্ষেপ করতে যাব না।’

আসুন, এবার এই ছোটখাটো আতঙ্কের ব্যবচ্ছেদ করি। ‘বাস্তব জগতের পরিণতির সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার’ মানে হলো একদম নির্মম বাস্তববাদ। ‘ক্রমান্বয়ে সংস্কারের’ মানে হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের ব্যাপারে কিছু করবে না। মানবতাবিরোধী অপরাধ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করবে না, যদি না সেটা ইরান, সিরিয়া, ইরাকি শিয়া, লেবানীয় শিয়া হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনি শিয়া হুতিরা করে থাকে।

আমাদের বিশ্বাস করার কথা ছিল, এর পুরোটাই ‘অংশীদারির’ বা ‘জোটগত’ ব্যাপার। বাজি ধরতে পারেন, ব্যাপারটা এ রকমই। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। আরবেরা যেহেতু একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে, তাই অবশ্যই তাদের রক্তক্ষরণ হওয়া উচিত, যাতে উৎসাহ জোগাচ্ছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী। তাই ট্রাম্প তাদের সবক দিয়েছেন, ‘ভার ভাগাভাগি করার’ প্রয়োজনীয়তা আছে। ‘শুভ শক্তি’ হিসেবে আরব ‘একত্র ও শক্তিশালী’ থাকবে। ট্রাম্প বলেছেন, এটা ‘সব ধর্মের শোভন মানুষের’ সঙ্গে ‘বর্বর শত্রুদের’ লড়াই। এটা ভালোর সঙ্গে মন্দের লড়াই। আর এই সব যুদ্ধ সৌদি আরবের ‘পবিত্র ভূমিতে’ শুরু হওয়ার কথা, ব্যাপারটা তাৎপর্যপূর্ণ, তাই নয় কি?

ট্রাম্প যে সুরে মন্দ লোকদের হুমকি দিয়েছেন, বক্তৃতার সময় সেই সুরে উঠে গেলে মনে হয়, তিনি আইএসের বক্তৃতা লেখক। এই মন্দ লোকদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি যদি সন্ত্রাসের পথ ধরেন, তাহলে আপনার জীবন শূন্য হয়ে যাবে। জীবন সংক্ষিপ্ত ও আপনার আত্মা নিন্দনীয় হবে।’ এসবই দারুণ ‘শাণ দেওয়া’। ট্রাম্প শান্তির কথা বলেছেন, কিন্তু আবার আরবদের শিয়া-সুন্নি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আরব নেতারা তাঁর বক্তৃতা শুনে হাততালি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কথার প্রকৃত অর্থ কী দাঁড়াল, সেটা কি তাঁরা ভেবে দেখেছেন?

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি