ট্রাম্পের যুগে পৃথিবী

>
জোসেফ ই স্টিগলিৎস
জোসেফ ই স্টিগলিৎস
স্বাগত ২০১৭, বিদায় ২০১৬।এই পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরটা কেমন গেল এবং নতুন বছরে আমাদের কী করণীয়, সে নিয়ে বিশ্বের পুরোধা ভাবুক ও নেতারা নিজেদের মত দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের লেখা ও একজনের সাক্ষাৎকার প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে ছাপা হচ্ছে, প্রতিদিন দুটি করে। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের লেখা বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় প্রকাশের একমাত্র অনুমোদনপ্রাপ্ত সংবাদপত্র প্রথম আলো। আজ ছাপা হলো জোসেফ ই স্টিগলিৎস ও ক্লাউস শোয়াবের লেখা।

২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন। আমি বলব, এটা বলতে আমার ঘৃণার উদ্রেক হয় যে ‘আমি আপনাদের এ কথা বলেছি’। কিন্তু তাঁর নির্বাচিত হওয়া নিয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই। ২০০২ সালে আমার বই গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্টস-এ বলেছিলাম, বিশ্বায়ন পরিচালনা করতে আমরা যেসব নীতি গ্রহণ করেছি, তাতে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে। পরিহাস হচ্ছে, যে মানুষটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থব্যবস্থাকে সমন্বিত করার সবচেয়ে কট্টর সমর্থক ছিলেন, সেই ব্যক্তিই এখন তা নাকচের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

অবশ্যই আমাদের পেছনে যাওয়ার অবকাশ নেই। চীন ও ভারত এখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কারণে সারা পৃথিবীতেই উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান কমছে। ট্রাম্প আগের যুগের ভালো বেতনের উৎপাদনশীল খাতের চাকরি পুনরায় সৃষ্টি করতে পারবেন না। তিনি শুধু উন্নত প্রযুক্তির উৎপাদনের ওপরই জোর দিতে পারেন, যার জন্য উচ্চ দক্ষতা প্রয়োজন, যে ব্যবস্থায় খুব অল্প কিছু মানুষকে দিয়েই কাজ করানো সম্ভব।
যে শ্বেতাঙ্গ ভোটারেরা ট্রাম্পকে বিজয় এনে দিয়েছেন, তাঁরা ক্রমবর্ধমান অসমতার কারণে আরও হতাশ হবেন; বিশেষ করে, মধ্য আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ ভোটারেরা। অর্থনীতিবিদ অ্যান কেস ও অ্যাঙ্গাস ডেটন ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ মার্কিনদের গড় আয়ু কমছে, তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যা, মাদক গ্রহণ ও অ্যালকোহল পানের আসক্তি বাড়ছে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিসটিকসের প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মার্কিনদের গড় আয়ু কমেছে।
২০০৮ সালের আর্থিক সংকট থেকে তথাকথিত উত্তরণের পর প্রথম তিন বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয়ের ৯১ শতাংশ শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের হাতে গেছে। করদাতাদের টাকায় ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকগুলোকে শত শত কোটি ডলারের বেইল আউট দেওয়া হলেও বাড়ির মালিকেরা সামান্য কিছু পেয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শুধু ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করেননি, তিনি ব্যাংকার, শেয়ার মালিক ও বন্ড মালিকদেরও রক্ষা করেছেন। ওয়াল স্ট্রিটের ভেতরের মানুষদের নিয়ে গড়া তাঁর অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নকারী দলটি অভিজাতদের রক্ষা করতে গিয়ে পুঁজিবাদের নিয়ম ভঙ্গ করেছে। এতে কোটি কোটি মানুষের মনে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে, এই ব্যবস্থা ‘প্রতারণাপূর্ণ’, যে কথা ট্রাম্প নিজেও বলে থাকেন।
ওবামা বেশ কিছু ক্ষেত্রে ‘চেঞ্জ ইউ বিলিভ ইন’ (যে পরিবর্তনে আপনি বিশ্বাস করেন) কার্যকর করেছিলেন, কিন্তু অর্থনীতিতে তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতি বজায় রেখেছিলেন। ৩০ বছর ধরে নব্য উদারনীতিবাদ নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে, অর্থাৎ বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের সুবিধাগুলো সবার মধ্যে ‘চুয়ে পড়বে’, সেই নীতি তিনি বজায় রেখেছেন। এর বদলে সুবিধাগুলো ওপরে গিয়ে জড়ো হয়েছে, যার আংশিক কারণ হচ্ছে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেটা ‘এক ডলার, এক ভোট’ নীতির ভিত্তিতে চলছে; ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’ নয়।
ক্রমবর্ধমান অসমতা, অন্যায্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও এমন এক সরকার—যে বলে সে মানুষের জন্য কাজ করছে, যদিও বাস্তবে সে অভিজাতদের জন্য কাজ করে, এসব কারণে ট্রাম্পের মতো প্রার্থীর পক্ষে পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। বিত্তশালী হলেও ট্রাম্প প্রথাগত অভিজাত শ্রেণিভুক্ত নন। ফলে তিনি যে ‘প্রকৃত’ পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছিলেন, তা হালে পানি পেয়ে যায়। তবে ট্রাম্পের অধীনে সবকিছু যথারীতি চলবে, যিনি লবিস্ট ও শিল্পপতিদের প্রশাসনে নিয়োগ দিয়ে রিপাবলিকানদের কর-সংক্রান্ত গোঁড়ামি ধরে রাখবেন। তিনি ওয়াশিংটন ডিসির আবর্জনা সাফ করার (ড্রেইন দ্য সোয়াম্প) যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা ইতিমধ্যে ভঙ্গ করেছেন।

ট্রাম্পের জমানায় কী হয়, আমরা তা দেখার অপেক্ষায়
ট্রাম্পের জমানায় কী হয়, আমরা তা দেখার অপেক্ষায়

ট্রাম্পের অন্যান্য অর্থনৈতিক অ্যাজেন্ডার সফলতা নির্ভর করছে হাউসের স্পিকার পল রায়ানের ওপর, মানে তিনি রাজস্ব নীতির ব্যাপারে প্রকৃত অর্থেই রক্ষণশীল কি না, তার ওপর। ট্রাম্প ধনীদের জন্য বিপুল হারে কর কর্তনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যার সঙ্গে অবকাঠামো খাতে বিপুল ব্যয় করা হবে, যার বদৌলতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। কিন্তু তিনি পণ্য ও সেবা উৎপাদনের ব্যাপারে অতটা জোর দিচ্ছেন না। রায়ান যদি রাজস্ব ঘাটতির ব্যাপারে অতটা উদ্বিগ্ন না হন, তাহলে তিনি ট্রাম্পের অ্যাজেন্ডায় বাদ সাধবেন না, তাতে অর্থনীতি কেইনসের মতবাদের আলোকে আর্থিক উদ্দীপনা পেয়ে যাবে, যেটা দীর্ঘদিন ধরেই প্রয়োজন। তবে রায়ান বলেছেন, ঘাটতির ব্যাপারে তাঁর উদ্বেগ আছে।
এদিকে মুদ্রানীতি নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই নিম্ন সুদের হারের বিপক্ষে কথা বলেছেন। ফেডারেল রিজার্ভের বোর্ড অব গভর্নরের দুটি পদ খালি আছে। তার সঙ্গে ফেডের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা সুদের হার স্বাভাবিক করার জন্য উসখুস করছেন। আর এতে বাজি ধরা যায় যে তাঁরা এটা করে ছাড়বেন। ট্রাম্প যে কেইনসীয় উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, এ কারণে সেটা একদম থিতিয়ে যাবে।
ট্রাম্প যদি কর প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে অসমতা আরও বাড়িয়ে ফেলেন বা বাণিজ্য যুদ্ধ ও গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের অঙ্গীকার বাতিল করেন, তাহলে তাঁর প্রবৃদ্ধিমুখী নীতি বাধাগ্রস্ত হবে। আর এখন তো হোয়াইট হাউসসহ দুই হাউসের নিয়ন্ত্রণই রিপাবলিকানদের হাতে। ফলে শ্রমিকদের দর-কষাকষিরÿ ক্ষমতা কমানোরÿ ক্ষেত্রে তাঁরা একরকম স্বাধীন। একই সঙ্গে ওয়াল স্ট্রিট ও অন্যান্য শিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণও হ্রাস করা হতে পারে। বিদ্যমান অ্যান্টি ট্রাস্ট আইনের প্রতিও তাঁরা চোখ বুজে থাকতে পারেন। আর এসব কিছু মিলে অসমতা আরও বেড়ে যাবে।
ট্রাম্প যদি নির্বাচনী প্রচারণার প্রতি সত্য থেকে চীনা আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে চীনের চেয়ে মার্কিন অর্থনীতিরই বেশি ক্ষতি হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব ক্ষেত্রে ‘অবৈধ’ শুল্ক আরোপ করবে, চীন যেকোনো জায়গায় তার প্রতিশোধ নিতে পারে। যেমন কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্টগুলোতে বাণিজ্য বাধা আরোপ করে চাকরিকে লক্ষ্যবস্তু করা যেতে পারে, যে ডিস্ট্রিক্টগুলো মার্কিন শুল্ককে সমর্থন করে।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাঠামোর মধ্যে চীনের বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমতি আছে, তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিক। যেমন অ্যান্টি ডাম্পিং ট্যারিফ। কিন্তু ট্রাম্প বাণিজ্যনীতির দিকনির্দেশনা প্রণয়ন করতে পারেননি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যে দোষে নিজে দোষী, সেই দোষে অন্যকেও দোষী সাব্যস্ত করতে শুরু করবে। মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র অটোমোবাইল ও এয়ারক্র্যাফট শিল্পে সরাসরি ভর্তুকি দেয়। অন্যদিকে ব্যাংকের সুদের হার খুবই কম রেখে পরোক্ষভাবে তাতে ভর্তুকি দেয়। এই ইটের বদলে পাটকেল মারার রীতি একবার শুরু হয়ে গেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে আন্তর্জাতিক সীমানা সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভেঙে পড়বে।
আন্তর্জাতিক পরিসরে আইনের শাসন তো অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে কার্যকর হয়, ট্রাম্পের অধীনে এই রীতিটার ঠিকঠাক প্রয়োগ না–ও হতে পারে। কথা হচ্ছে, রুশপন্থী সেনাদের কারণে যদি পূর্ব ইউক্রেনে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বেড়ে যায়, তাহলে নতুন প্রেসিডেন্ট কী করবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির উৎস হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, সব সময় ব্যাপারটা তা-ই ছিল। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় খুব একটা আস্থা নেই। আফ্রিকায় আমি এ কথা শুনেছি, ‘ট্রাম্পের কারণে আমাদের একনায়কেরাও জায়েজ হয়ে যান’। ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রভাব ক্ষয় হতে থাকলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টি নিশ্চিতভাবেই নির্বাচনের ময়নাতদন্ত করবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ১৯৯০-এর দশকে বিল ক্লিনটন যে নব্য উদারনীতিবাদী অ্যাজেন্ডা হাতে নিয়েছিলেন, হিলারি তার চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন নীতি ভোটারদের সামনে হাজির করতে পারেননি। ওদিকে বামেরা বহুকাল ধরে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছে, যাকে বলে ট্রায়াঙ্গুলেশন। ফলে তারা নিজেদের আর ডানদের বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে দাবি করতে পারে না।
ডেমোক্র্যাটরা যদি নব্য উদারনীতিবাদী অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং এলিজাবেথ ওয়ারেন, বার্নি স্যান্ডার্স ও শেরড ব্রাউনের প্রগতিশীল নীতি গ্রহণ করেন, তাহলে তাঁদের ভবিষ্যৎ আছে। এতে রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান শক্তিশালী হবে। তখন রিপাবলিকানদের ভাবতে হবে, ইভানজেলিকাল খ্রিষ্টান, করপোরেট নির্বাহী, নেটিভিস্ট, জনপ্রিয়তাবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঐক্য কীভাবে ধরে রাখা যায়।
ট্রাম্পের আগমন ও দুই প্রধান দলের আত্মসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সামনের বছরগুলো মার্কিন ও বিশ্ব ইতিহাসে সন্ধিক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেল পুরস্কারজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।