ঠান্ডা মাথায় খুন না গরম মাথায়?

ছাত্র–শিক্ষক ও সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদই আশা জাগাতে পারে
ছাত্র–শিক্ষক ও সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদই আশা জাগাতে পারে

কয়েক বছরের ব্যবধানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন কৃতী শিক্ষককে নৃশংসভাবে খুন করা হলো। ‘আপাত’ সবশেষ শিকার হলেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী।
পর্যায়ক্রমিক এসব ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিবেকবান মানুষেরা জানতে চান, কেন বারবার এ রকম হচ্ছে? এই কেন-এর জবাব কি আমাদেরও সবটা জানা? যাঁরা জানতে চান, তাঁরাও এটা বোঝেন যে, সরাসরি জবাব আমাদের জানা নেই। তবু তাঁরা সহমর্মিতা প্রকাশ করেন, আমাদের সাবধানে থাকতে বলেন। ঘটনার পর কয়েক দিন ক্লাস বন্ধ থাকে। আমরা প্রতিবাদী শোক মিছিলে শামিল হই, মানববন্ধন
করি। তারপর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আমরা আবার ক্লাসে যাই এবং বলতে যতই খারাপ শোনাক না কেন, আমরা যেন পরবর্তী আর একটা ঘটনার অপেক্ষায় থাকি। অথচ আমাদের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, আমরা আর এমন শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না! আমরা আর আমাদের সহকর্মীদের এভাবে হারাতে চাই না!
রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের পর সহকর্মীদের অনেকেই বলছেন, যদি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত
করা না যায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হোক। ক্ষোভের কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ক্ষোভের মধ্যে কি সারবস্তু একেবারেই নেই? যেভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকা মানেই তো আবার নতুন কোনো ঘটনার মুখোমুখি
হওয়া। আমরা অধ্যাপক ইউনুসকে হারালাম, অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ নিজ বাড়িতে খুন হলেন, অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে
তাঁর বাড়ির আঙিনায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। সবশেষে একইভাবে খুন হলেন অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী। আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর হয় বিচার হলো না, নয়তো বিচার–প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ রইল। কোনো কোনো হত্যাকাণ্ডের রহস্যই উদ্ঘাটিত হয়নি। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠতেই পারে।
আমরা বলছি যে একের পর এক এমন ঘটনা কেন ঘটছে, আমরা তা জানি না। সুনির্দিষ্ট কোনো একটি ঘটনার ক্ষেত্রে এই জবাব হয়তো সত্যি। কিন্তু দেশের সামগ্রিক ঘটনার বিচারে কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে, জবাব আমাদের জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় হলো
মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। কারও পছন্দ হোক বা না হোক, যে কেউ যেকোনো বিষয়ে জ্ঞানচর্চা করবেন, এটাই বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার মূল মর্ম। সুতরাং আমরা যদি এ কথা স্বীকার করে নিই যে, দেশে মুক্তচিন্তার ওপর একের পর এক আঘাত আসছে, তাহলে এই
আঘাত যে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপরই আসবে, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদারমনা শিক্ষকদের ওপর আঘাত এ কারণে কোনো ব্যক্তিক বিষয় নয়, এ হলো প্রগতির চিন্তার ওপর আঘাত।
মৌলবাদী চিন্তার মূল কথা হলো, সে চিন্তা স্থির। তা যেমন পাল্টায় না, তেমনই পরিবর্তিত হয় না। সুতরাং মৌলবাদীরা তাদের স্থবির চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে গিয়ে প্রগতির চিন্তার ওপর আঘাত করবে—এটাই স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন হলো আমরা প্রগতির ধারকেরা এই আঘাত হানার সুযোগ করে দিচ্ছি কি না।
হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না এটা যেমন সত্যি, তেমনই এ-ও সত্যি যে, সাম্প্রতিক সময়ে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সুসংগঠিত ধারাবাহিক কোনো প্রতিবাদ সমাজ থেকে উঠে আসছে না। আমরা গতানুগতিক কতগুলো কর্মসূচি দিয়েই অবস্থার পরিবর্তন প্রত্যাশা করছি। অন্যদিকে একটা ঘটনার প্রতিবাদ শেষ না হতেই এসে যাচ্ছে আর একটা ঘটনা। ফলে সহজেই খেই হারিয়ে ফেলছি। এভাবে সামগ্রিক ঘটনার গভীরে প্রবেশের প্রজ্ঞা ও ইচ্ছা দুই-ই সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এদিকে কোথাও প্রতিবাদের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রবণতা দেখা দিলে তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

>আইএস মারছে না আনসার আল ইসলাম মারছে—এই বিতর্কের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হলো, মানুষ খুন করা হচ্ছে—মানুষ মরছে, এভাবে চলতে পারে না

রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে তাঁর শালবাগানের বাড়ি থেকে মাত্র ত্রিশ গজ দূরে যখন কুপিয়ে হত্যা করা হলো, তখন সকাল সাড়ে সাতটা। এই সময়ে ঘটনাস্থলের আশপাশে অনেকেই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে, নিজ চোখে দেখা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে এখন কেউই মুখ খুলছেন না। তাঁরা ভয় পাচ্ছেন। সমাজে এই ভীতির সংস্কৃতি তখনই চালু হতে পারে, যখন সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারেন ঘটনার কোনো বিচার হবে না, প্রত্যক্ষদর্শীদের পক্ষে কেউ এগিয়ে আসবে না—আখেরে বিপদে পড়তে হবে তাঁদেরই, যাঁরা ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর মুখ খুলেছিলেন। আমরা জানি না সমাজের এই নির্লিপ্তপ্রবণতা সামগ্রিক অগ্রগতির পথে কতটা সহায়ক।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর থেকেই লক্ষ করা যাচ্ছে ছাত্র-যুবসমাজের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনা কমে আসছে। দীর্ঘ বিরতির পর শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আমাদের আশাবাদী করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশাহত হতে আমাদের সময় লাগেনি। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠনে নেতৃত্বের কর্মকাল, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের নগ্ন দলবাজি, প্রাইভেট, কোচিং ও পরীক্ষার ফলাফলকেন্দ্রিক লেখাপড়া ছাত্রসমাজকে বিভ্রান্ত করছে। তারা এখন সাদা আর কালোর মধ্যে প্রভেদ করতে পারছে না। এ অবস্থায় অন্যায়-অত্যাচার আর অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ ভেঙে পড়ছে।
অন্ধকার যত গভীর হয়, ভোরের আলোটাও তত এগিয়ে আসে। আমাদের প্রিয় সহকর্মী রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের পরদিন রোববার শিক্ষক সমিতির প্রতিবাদ সমাবেশে যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের উপস্থিতি দেখা গেছে, তাতে আমরা অনেকটা আশাবাদী হই। পাশাপাশি ইংরেজি বিভাগ, সাংস্কৃতিক জোট, রাজশাহী শহরের বিবেকবান মানুষ এবার যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন, তাতে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা সত্যি সত্যি সক্রিয় হয়ে উঠবেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাদের দেশে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আমরা এ-ও জানি যে এসব তৎপরতা বর্তমানে বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে এবং এর সঙ্গে ভূরাজনৈতিক বিষয়াবলিও যুক্ত হয়েছে। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আইএস বনাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বিতর্কও চলছে সমানতালে। এ দেশে কিছু ঘটলেই আইএস তা ঘটিয়েছে, এমন দাবি করছে কেউ কেউ। ওদিকে সরকারের তরফ থেকে বারবার দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই।
পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আমি এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত বিষয় উল্লেখ করছি। ২০০৫ সালে আমি হত্যার শিল্পকলা নামে
একটি নাটক লিখি। নাটকের বিষয়বস্তু বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ। একটি দৃশ্যে দুই জঙ্গিনেতা ঠান্ডা মাথায় খুন করা হবে, নাকি গরম মাথায় খুন
করা হবে—এ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়। একজন বলছে, খুন করতে হবে ঠান্ডা মাথায়। জবাবে অন্যজন বলছে, আসলে মাথা গরম না থাকলে খুন করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলার বা উনিশ শ একাত্তরে ইয়াহিয়ার মাথা যদি ঠান্ডা থাকত তাহলে তাঁদের পক্ষে এত মানুষ খুন করা সম্ভব হতো না। সুতরাং মাথা গরম করেই খুন করতে হবে।
দুই জঙ্গিনেতার এই বিতর্কের মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করে এক পরিচারক। সে দুই নেতাকেই থামতে অনুরোধ করে এবং শ্লেষের সঙ্গে বলে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে নিহত ব্যক্তিদের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করে দেখা যেতে পারে তাদের ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে, নাকি গরম মাথায় খুন করা হয়েছে।
২০০৫ সালে লেখা ওই নাটকে পরিচারকের সংলাপটি আজ এভাবে ফলে যাবে ভাবিনি। আইএস মারছে না আনসার আল ইসলাম মারছে—এই বিতর্কের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হলো, মানুষকে খুন করা হচ্ছে—মানুষ মরছে, এভাবে চলতে পারে না। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবাই অহেতুক ঠান্ডা মাথা-গরম মাথার বিতর্কে লিপ্ত না হয়ে, বিষয়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক হবেন।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।