শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ছোট্ট একটি জটলা দেখে এগিয়ে যান মালেক (ছদ্মনাম) সাহেব। জাদুঘরের সামনে অবশ্য প্রতিদিনই কোনো না কোনো সভা, মানববন্ধন, বাদ-প্রতিবাদ ও সমাবেশ হয়ে থাকে। কোনো কোনো সভা মঞ্চ বানিয়ে, আবার কোনো কোনোটি প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে খোলা আকাশের নিচে অনুষ্ঠিত হয়। সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন—সে ছোট-বড় যা-ই হোক, মাইকের ঘোষণা এবং বক্তাদের বক্তব্য বেশ দূর থেকেই যেমন শাহবাগ থানা, পাবলিক লাইব্রেরি (জাতীয় গণগ্রন্থাগার), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বারডেম হাসপাতালের আশপাশ থেকেও শোনা যায়।
কিন্তু মালেক সাহেব লক্ষ করে দেখলেন, আজ আশপাশে কোনো সভা-সমাবেশ বা মানববন্ধন হচ্ছে না। তাহলে এখানে কাদের জটলা? করোনায় স্বাস্থ্যঝুঁকি সত্ত্বেও নিরাপদ দূরত্বে থেকে তিনি জটলাকারীদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন জটলার কারণ। জটলাকারীদের অন্যতম সাগর মিয়া (ছদ্মনাম) হাজারীবাগসংলগ্ন বস্তির বাসিন্দা। ছুটির দিন বলে সাগর মিয়া সস্ত্রীক ছেলেমেয়ে, বন্ধুবান্ধব, তাঁদের পরিবার-পরিজনসহ ১২ থেকে ১৪ জনের এক ছোটখাটো দল নিয়ে জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শনে এসেছেন। সদলবলে জাতীয় জাদুঘর, শিশুপার্ক, স্বপ্নপুরী প্রভৃতি স্থাপনা পরিদর্শন এ দেশে নতুন কিছু নয়। করোনা-পূর্ব সময়ে রাজধানী তো বটেই, অপরাপর বড় শহর, গ্রামগঞ্জ, মফস্বলের অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী বাস ভর্তি হয়ে, বাসের বাইরে ব্যানার টাঙিয়ে, ভেতরে নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস করতে করতে ‘শিক্ষাসফরে’ আসত জাদুঘর বা এ ধরনের স্থাপনা পরিদর্শনে।
জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে দক্ষিণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি পর্যন্ত সারি করে রাস্তার ধারে রাখা হতো সেই বাসগুলো। লাইন ধরে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী তাদের নির্ধারিত পোশাক পরে ভেতরে ঢুকত, নানা কিছু দেখে শেখার পাশাপাশি নির্মল আনন্দ উপভোগ করত। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শনে আসত। করোনার কারণে জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কায় সংগত কারণেই সরকার স্কুল-কলেজ, পার্ক, শপিং মলসহ অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্র বন্ধ রাখে। জনগণও যথেষ্ট সহযোগিতা করে। কিন্তু করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় সরকার চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, শপিং মলসহ অন্যান্য বিনোদনকেন্দ্র কোনোটা পুরোপুরি, কোনোটা সীমিত পরিসরে খুলে দিয়েছে। টেলিভিশনে এমন খবর শুনেই সাগর মিয়া ও তাঁর নিকটজনেরা জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শনে এসেছেন।
সামর্থ্যবান তো বটেই, অনেক গরিব মানুষও ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের অনেকেই হয়তো ন্যূনতম বিনোদনের মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার ইত্যাদির বাইরে বাস্তব জীবনে ডিজিটাল টেকনোলজির ব্যবহার সম্পর্কে জানে না।
তো জটলার কারণ হলো, জাতীয় জাদুঘরের সামনে টাঙানো এক ব্যানার। ব্যানারে যা লেখা, তার সারমর্ম হলো এই—সাময়িকভাবে জাদুঘরের টিকিট বিক্রয়কেন্দ্রে কোনো টিকিট বিক্রয় হচ্ছে না। সেখানে ওয়েবসাইটের লিংক দেওয়া আছে, যেখানে নিবন্ধন করে টিকিট কাটতে হবে। অনলাইনে কাটা সেই টিকিট প্রিন্ট আউট করে সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশের জন্য। সাগর মিয়া এসব কিছু জানেন না। এখন জাদুঘরের সামনে এসে থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, গেটে দারোয়ানদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা করছেন। অবাধ্য ছেলেমেয়েগুলো ভেতরে ঢোকার জন্য অস্থির হয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছে, সঙ্গে থাকা স্ত্রী ভ্রুকুটি কাটছেন, বন্ধু ও তাঁর পরিবারের লোকজন তাঁকে অযোগ্য বিবেচনায় হেয়প্রতিপন্ন করছেন।
এ দেশে শহর বা গ্রাম হোক আর অট্টালিকা বা বস্তিতেই হোক, কোটি কোটি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করে, মেগাবাইট কিনে হলেও ইন্টারনেট চালায়। সামর্থ্যবান তো বটেই, অনেক গরিব মানুষও ফেসবুক, ইউটিউব ব্যবহার করে। কিন্তু তাদের অনেকেই হয়তো ন্যূনতম বিনোদনের মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার ইত্যাদির বাইরে বাস্তব জীবনে ডিজিটাল টেকনোলজির ব্যবহার সম্পর্কে জানে না। আর সে কারণেই সাগর মিয়াদের মতো অনেকেই ভোগান্তির শিকার হন।
মালেক সাহেবের মনে পড়ল, শুধু সাগর মিয়াদের মতো পিছিয়ে পড়া লোকজনই নয়, সমাজের অপরাপর শ্রেণি-পেশার মানুষও অনেক ক্ষেত্রে ডিজিটাল ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। মালেক সাহেবের বন্ধু গোত্রীয় হাবিব সাহেব (ছদ্মনাম) সেদিন তাঁর আক্ষেপের কথা বলছিলেন। হাবিব সাহেব একটি পুরোনো গাড়ি (প্রাইভেট কার) কিনেছেন গত বছরের অক্টোবরে। যথারীতি রেজিস্ট্রেশন করিয়েছেন। ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স, টোকেন ফি ইত্যাদি পরিশোধ করেছেন গত বছরেই। গাড়ি কেনার পর ‘ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড’ বা মালিকানার স্মার্ট কার্ডের জন্য তিনি নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রেশন বুথে উপস্থিত হয়ে ছবি তুলে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে এসেছেন সেই গত বছরের ডিসেম্বরে। মাঝে কয়েকবার হাবিব সাহেব সশরীর নির্ধারিত অফিস ঘুরে এসেছেন তাঁর স্মার্ট কার্ডের তথ্য জানার জন্য। কোথাও কোনো সদুত্তর না পেয়ে এখন প্রায় এক বছর ধরে অপেক্ষা করছেন তাঁর ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন কার্ডের জন্য। হাবিব সাহেব মালেক সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন, এ কেমন ডিজিটাল রে ভাই? মালেক সাহেব নিরুত্তর।
মালেক সাহেব নিজেও বেশ কয়েকবার ডিজিটাল অস্বস্তিতে পড়েছেন নিকট অতীতেই। একবার কোনো এক দরকারি কাজে ব্যাংকের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দরকার হয়। মালেক সাহেব সশরীর হাজির হন তাঁর ব্যাংকের শাখা অফিসে। চাকচিক্যময় স্বনামধন্য বেসরকারি ব্যাংকটির স্মার্ট অফিসারদের টেবিলে টেবিলে লেখা ‘অন স্টপ সলিউশন’, যার সরল অর্থ দাঁড়ায় ন্যূনতম সময়ে অন্য কোনো টেবিল না ঘুরেই সমাধান। মালেক সাহেব আশান্বিত হয়ে চেয়ার খালি দেখে এক স্মার্ট অফিসারের সামনে বসে একটি অনাপত্তিপত্রের জন্য আরজি জানান।
স্মার্ট ব্যাংকার মালেক সাহেবের দিকে একটি আবেদনপত্র ঠেলে দেন। গরগর করে মালেক সাহেব আবেদনপত্রটি পূরণ করে ফেলেন। মালেক সাহেবের আশার গুড়ে বালি দিয়ে ব্যাংকার তাঁকে চার থেকে পাঁচ কর্মদিবস (ওয়ার্কিং ডে) পরে যোগাযোগ করতে বলেন। দয়াপরবশ হয়ে ব্যাংকার মালেক সাহেবকে তাঁর ফোন নম্বর দেন, যাতে নিশ্চিত হয়ে আসতে পারেন। মনে কষ্ট নিয়ে সেই ব্যাংক থেকে বের হচ্ছেন আর মালেক সাহেব ভাবছেন এই কিছুদিন আগেই রাষ্ট্রায়ত্ত একটি বড় ব্যাংকের ডিজিটাল ভোগান্তির অভিজ্ঞতার কথা।
এ দেশে অনেক ব্যাংক অনেক দিন ধরেই ‘অ্যানি ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং’ সেবা দিয়ে আসছে। ‘অ্যানি ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং’ হলো এমন এক ব্যাংকিং সেবা, যেখানে কোনো ব্যাংকের একজন গ্রাহক সেই ব্যাংকের যেকোনো শাখা থেকে অনায়াসে ব্যাংকিং করতে পারে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ডিজিটাল বা ‘এমআইসিআর’ চেক চালু হওয়ার পর এ ব্যবস্থা খুব সহজ, নিরাপদ ও জনপ্রিয় হয়। মালেক সাহেবের জরুরি প্রয়োজনে কিছু টাকা ওঠানোর প্রয়োজন হলে তাঁর ব্যাংকের নিকটতম শাখায় উপস্থিত হয়ে ‘ডিজিটাল চেক’ দিয়ে টাকা ওঠাতে যান। ক্যাশ কাউন্টারে তিনি টাকা ওঠাতে পারলেন ঠিকই কিন্তু সে জন্য তাঁকে উল্লেখযোগ্য খরচ (ফি) দিতে হয়। মালেক সাহেব ভাবতে থাকেন, একই রকম সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংক কোনো চার্জ নেয় না; কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক চার্জ নেয়। তিনি ভাবেন, এ কেমন ডিজিটাল ব্যাংকিং? শুধু কি তা-ই? একবার দুই কর্মদিবস আগেই ব্যাংক বুথে ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধের পরও তাঁর নামে বিলম্ব মাশুল এসেছিল। ‘কল সেন্টার’-এ কল করে তিনি জানতে পেরেছিলেন, টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে তাঁর বিল সময়মতো জমা হয়নি। সে দায় কার? সেটি কি ডিজিটাল ভোগান্তি?
উন্নত দেশে জন্মের পরপরই প্রত্যেক শিশুসন্তানের জন্য একটি ইউনিক পরিচয়পত্র এবং নম্বর প্রদান করা হয়। আমাদের দেশে ডিজিটাল টেকনোলজির বিস্তার এবং তার সামগ্রিক ব্যবহার ও তার কার্যকারিতা নিয়ে খুব বেশি ভাবা হয়েছে কি?
মালেক সাহেব ভাবেন, করোনার টিকাদানের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল ভোগান্তিতে পড়েছেন এ দেশের লক্ষকোটি মানুষ। সরকার বহুমুখী উদ্যোগে বিভিন্ন দেশ থেকে টিকার ব্যবস্থা করতে পারলেও করোনার টিকা প্রদানে সাফল্য অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জের হবে। নির্ধারিত সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধনের মাধ্যমে খুদে বার্তা প্রাপ্তি সাপেক্ষে টিকাদান আজ চ্যালেঞ্জের মুখে। এটাই বাস্তবতা যে আমাদের শহর, মফস্বল, গ্রামগঞ্জের লাখো মানুষ এখনো ইন্টারনেট, স্মার্টফোন ইত্যাদি সেবার নেটওয়ার্কের বাইরে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যেমন কৃষক, জেলে, কামার, কুমার, নির্মাণশ্রমিক, গাড়িচালক, উপজাতি, প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা, বয়স্ক, বিধবা নারী, প্রতিবন্ধী নারী, পুরুষ অনেকেই ডিজিটাল সেবা থেকে বঞ্চিত।
এমনকি অনেক শিক্ষিত লোকের ভেতরও ‘টেকনোভীতি’ বা ডিজিটাল টেকনোলজির প্রতি একধরনের ভয় লক্ষণীয়। আর তাই শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে করোনার টিকাদানের মতো ‘গণটিকাদান’ কর্মসূচিতে অনেক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার কথা শোনা যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে কোটি কোটি টিকা সংগ্রহ সম্ভব হলেও বাস্তবতার নিরিখে সেই টিকা সফলভাবে প্রয়োগ করে কোটি কোটি মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা আজ অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার ঘোষণা এবং ছাত্রছাত্রীদের সার্বিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদেরও করোনা টিকার আওতায় আনার কথা সরকার বিবেচনা করছে। যদি তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিবন্ধনের কী হবে?
১২ বছরের ওপরে এবং ১৮ বছরের নিচে ছাত্রছাত্রীদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে যা অতি প্রয়োজনীয়। গ্রামগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী অনেক শিশুর জন্মনিবন্ধন নম্বরও নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ছাড়াও অনেক স্বার্থান্বেষী, লোভী মানুষ টিকা-বাণিজ্য করতে পারে। শহর-গ্রামভেদে বৈষম্যও সৃষ্টি হতে পারে। বলা বাহুল্য, উন্নত দেশে জন্মের পরপরই প্রত্যেক শিশুসন্তানের জন্য একটি ইউনিক পরিচয়পত্র এবং নম্বর প্রদান করা হয়। আমাদের দেশে ডিজিটাল টেকনোলজির বিস্তার এবং তার সামগ্রিক ব্যবহার ও তার কার্যকারিতা নিয়ে খুব বেশি ভাবা হয়েছে কি? যদি না হয়ে থাকে, তবে জনজীবনে প্রতিদিন প্রতিপদে ডিজিটাল ভোগান্তি শেষ হবে কবে?
ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক।