করাচির বন্যা : ডুবছে দেশহীন বাংলাভাষীরা

করাচিতে বন্যা।এএফপি ফাইল ছবি।

পাকিস্তানের সাবেক রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় বন্দর শহর করাচি পানিতে সয়লাব হয়েছে। বলা হচ্ছে করাচি এক শ বছরেও এত পানি দেখেনি। রাস্তায় চলেছে নৌকা। বানের পানিতে অনেক কিছু ভেসে যায় আবার ভেসে ওঠে নানান চেপে থাকা কষ্ট লুকিয়ে রাখা আবর্জনা আর তা সরিয়ে ফেলার পুরোনো আশ্বাস। করাচি আর সিন্ধের ফতুর করা বন্যায় সে রকম করেই আবার ভেসে উঠেছে মনে না থাকা কিছু কষ্ট। সেখানে তিন জন্ম থেকে বসবাসকারী প্রায় ২২ লাখ বাংলাভাষীর বঞ্চনা আর মানবেতর জীবনের করুণ কাহিনি।

করাচিতে বাংলাভাষীদের যাতায়াত আর বসবাসের ইতিহাস দেশভাগের অনেক আগে থেকেই। বাংলাভাষীরা যেমন ভাগ্যের অন্বেষণে রেঙ্গুন গেছে; তেমনি করাচি, বোম্বাই, লাহোরেও গেছে। কেউ থেকে গেছে, কেউবা আবার ফেরত এসে ফিরেও গেছে। জাহাজের খালাসি থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষ ছিল সেই দলে। ডাক্তার, উকিল, মোক্তার, আমিন প্রভৃতি পেশার মানুষ গেছেন–এসেছেন। করাচির মৎস্যশিল্পের মেরুদণ্ড ছিল বাংলাভাষীরা।

বলা হয়, ব্রিটিশদের আগে বাংলাভাষীরা আসে সিন্ধে। মাছ ধরার কাজে তাদের পারদর্শিতার জন্য বর্তমান বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে জেলেদের নিয়ে যান করাচির উর্দুভাষী ব্যবসায়ীরা। বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই ছিল সেই দলে। ব্রিটিশরা আসার পর ব্যবসায়ীরা সমুদ্রের ধারে জেলেদের কলোনি গড়ে দেন। সময়টা ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। এই বাঙালি মৎস্যজীবীরা দ্রুত করাচির উর্দুভাষী বাসিন্দাদের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেন। দ্রুত শিখে নেন উর্দু ভাষা, কিন্তু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ভোলেননি। দেশভাগের পর স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের করাচিমুখী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। রাজধানী ছাড়াও করাচি তখন পাকিস্তানের একমাত্র বাণিজ্যিক শহর চাকরি–বাকরির ছড়াছড়ি। আগে থেকেই থাকা মানুষের সঙ্গে নতুন আসা বাংলাভাষীরা দেশটাকে নিজেদের ভেবে পাকা পত্তন গড়তে শুরু করে।

করাচিসহ সারা পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাভাষীদের বাড়বাড়ন্ত এমন পর্যায়ে চলে যায়, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু করতে হয়। ঢাকায় তখন ছাত্ররা বাংলা ভাষার জন্য রাজপথে বুকের রক্ত দিচ্ছে। ১৯৫৩ সাল থেকে চালু বাংলা বিভাগ এখনো ৬৭ বছর ধরে বিরতিহীনভাবে চলছে।

একাত্তরে পাকিস্তানিদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়লে অনেকেই করাচির পাততাড়ি গুটিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। কিন্তু ’৪৭–এর দেশভাগের পর যেমন উপমহাদেশের সব মুসলমান পাকিস্তানে চলে যায়নি, তেমনি অনেকই ’৭১–এর পর পাকিস্তানের করাচি, সিন্ধু ছেড়ে চাকরি–ব্যবসা, বাড়িঘর, বিবি ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে পারেনি। এমন নয় যে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের কারণে থেকে গেছে সে দেশে। থেকেছে রুজির কারণে। আবার এক অনিশ্চিত যাত্রার খপ্পরে না পড়ে কষ্টেশিষ্টে থেকে যাওয়ার ঝুঁকিটা নিয়েছিল তারা।

কালামুদ্দিন কিন্তু ফিরে এসেছিলেন কিশোরগঞ্জে তাঁর বাপ–দাদার ভিটায়। পঞ্চাশ সাল থেকে তিনি করাচিতে দরজির কাজ করতেন, পরে তারেক রোডে নিজের দোকান গড়ে তোলেন। শেরওয়ানি আর কোট ফিটিংয়ে তাঁর জুড়ি ছিল না। লাহোর, লারকানা, পেশোয়ার, মুলতান থেকে অর্ডার আসত তাঁর। কালাম কাট তখন পাকিস্তানের সেরা কাট। এ রকম রমরমা অবস্থা ছেড়ে চলে এসেছিলেন কালামুদ্দিন। দেশে এসে দেখেন তিনি এক অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। তাঁর পাঠানো টাকায় বাড়িঘর, দালান হয়েছে, মাঠে জমি–জিরাত বেড়েছে, কিন্তু কিছুই তাঁর নামে নয়। অনেক কষ্টে তিনি আবার ফিরে যান তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে। কাজ জানতেন, তাই করে খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু পাসপোর্ট আর পাননি। একাত্তরের পর পাকিস্তানে থেকে যাওয়া সব বাংলাভাষীকে গাদ্দারের (বিশ্বাসঘাতক) তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়। আজও ঘোচেনি সেই আরোপিত বদনাম।

মানবাধিকার কমিশনের আসাদ বাট বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পাকিস্তানে বাঙালিরা ঘৃণার শিকার হয়ে পড়ে। তাদের ছোট চোখে দেখা শুরু হয়, বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখা শুরু হয়। রাখঢাক না রেখেই বৈষম্য শুরু হয়। আসাম থেকে বাংলাভাষীদের খেদানোর জন্য যেমন এনআরসি করা হয়েছে, পাকিস্তানে তেমনি তৈরি করা হয়েছে এনডিআরএ (ন্যাশনাল ডেটাবেইস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি)। বাপ–মা চৌদ্দগুষ্টির কেউ বাংলাভাষী হলে সে পাকিস্তানি নয়। এনডিআরের কার্ড না থাকলে সে হাসপাতাল, স্কুল–মাদ্রাসা, অফিস–আদালত সব জায়গায় অবাঞ্ছিত।

বেশির ভাগ বাংলাভাষী কলোনির বাইরে খুব একটা বের হয় না। এলাকার বাইরে বের হলে পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে যায়। ফলে কলোনির ভেতরেই ‘পাঠান’ আর আফগানিদের ছোটখাটো কারখানায় নামমাত্র পয়সায় দিনমজুরের কাজ করতে হয় অধিকাংশকে। অথচ করাচির মৎস্যশিল্প দাঁড়িয়ে আছে তাদের শ্রমের ওপর। পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা সস্তা শ্রমিক পান। তাই তাঁরা চান ওরা থাকুক। কিন্তু নাগরিকত্ব বা তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নের জন্য কোনো চিন্তা নেই। বাংলাভাষীরা নাগরিক নয়, সুতরাং তাদের ভোট নেই। ফলে রাজনীতিকেরা তাদের নিয়ে মাথা ঘামান না।

ক্ষমতায় আসার আগে–পরে নতুন পাকিস্তানের যে জিগির তুলেছিলেন ইমরান খান, তা এখন ঠান্ডাঘরে। নতুন পাকিস্তানের হিস্যার মধ্যে করাচির বাংলাভাষীরাও থাকবে বলে তিনি ইঙ্গিত দিলেও বন্যার মতো দুর্যোগেও তাদের ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি।

করাচি সিটি সেন্টার থেকে ইব্রাহিম হায়দেরি এলাকায় যেতে গাড়িতে লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। আগে ইব্রাহিম হায়দেরি ছিল ছিমছাম একটি জেলেপল্লি, এখন এটি হয়ে উঠেছে করাচির নোংরা ঘিঞ্জি এক জনপদ, বাসিন্দাদের প্রায় সবাই বাংলাভাষী। এর মধ্যে পাকিস্তানের অন্য শহর থেকে আসা বাংলাভাষীরাও আছে। নিচু এলাকা আর নালা–নর্দমার ব্যবস্থা না থাকার কারণে এসব অঞ্চলে পানি আটকিয়ে দীর্ঘ বন্যায় হাবুডুবু খেয়েছে এখানকার বাসিন্দারা। মারা গেছে ১২১ জন। কাফনের কাপড় কেনার পয়সা ছিল না অনেকের। এক ছটাক সরকারি সাহারা মেলেনি এসব মানুষের। বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ‘ইদি ফাউন্ডেশন’ ছাড়া কেউ তাদের দেখতেও আসেনি। অভিযোগ আছে, সে দেশের জাতীয় রেডক্রস, রেড ক্রিসেন্টের বিরুদ্ধে তারাও এনডিআরের কার্ডকেন্দ্রিক ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছে। বাংলাভাষী সাবেক কাউন্সিলর রাশেদা খাতুনের এ অভিযোগ এখনো মিথ্যা বলেনি কেউ। করাচি শহরের মাচ্ছার কলোনির বাসিন্দা রাশেদা খাতুনেরা বারবার প্রতারিত হয়েছে। কোভিডে রোজগার হারিয়েছিল, বন্যায় ঘর হারিয়েছে করাচির বাংলাভাষীরা। তাদের কোনো দেশ নেই, যে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছে তারা, সে দেশে কি মানুষ নেই।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক

[email protected]