ড্রোন কাহিনি ও এক বালিকার আর্তি

ড্রোন হামলায় স্বজন হারানো পাকিস্তানের নাবিলা এখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠ
ড্রোন হামলায় স্বজন হারানো পাকিস্তানের নাবিলা এখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিরোধী কণ্ঠ

যুদ্ধটা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা অঙ্গরাজ্যের মরুভূমিতে। এক হাজারের বেশি ড্রোনের পাইলট সেখানে পালাক্রমে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা টিভি মনিটরের সামনে বসে থেকে যেন খেলে চলেছেন টান টান উত্তেজনায় ভরা ভিডিও গেমস। দিনে তাঁদের গড়পড়তা পরিচালনা করতে হয় ৬৫টি মিশন, যেগুলোর লক্ষ্যবস্তুর বিস্তৃতি হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশের বুকজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গড়ে ওঠা জঙ্গিঘাঁটি থেকে শুরু করে ইয়েমেনের গিরিখাত হয়ে সিরিয়ার পাহাড়ি ভূখণ্ড ধরে ইরাকের মরুভূমি এবং সেখান থেকে আরও পূর্ব দিকে আফগানিস্তানের দূরবর্তী সব গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত। নেভাডা থেকে সেসব জায়গার দূরত্ব কয়েক হাজার মাইল।
ভিডিও গেমস যাঁরা খেলছেন, তাঁরা স্কুলগামী বালক কিংবা ভিডিও গেমসে বুঁদ হয়ে থাকা নেশাগ্রস্ত যুবক নন, বরং পেশাদার সৈনিক। সেই কাজের জন্য তাঁরা যে নিয়মিতভাবে বেতন পাচ্ছেন তা-ই কেবল নয়, সেই সঙ্গে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠার পর জুটছে পদস্থ সেনা কর্মকর্তার পদবিও। আর কাজটা তাঁদের জন্য অনেক সহজ এ কারণে যে তাঁদের মধ্যে অনেককেই ভিডিও গেমসের নেশায় মোহাচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় সৈনিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিরীহ সাধারণ মানুষ হত্যার মানসিক যন্ত্রণা থেকেও এঁরা মুক্ত। কেননা, ভিডিও মনিটরেই তা কেবল তাঁদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। ড্রোন হামলায় এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার একটি হচ্ছে আফগানিস্তানের সীমান্ত বরাবর অবস্থিত পাকিস্তানের উপজাতীয় এলাকা উত্তর ওয়াজিরিস্তান ও আশপাশের কয়েকটি অঞ্চল। তালেবান আর আল-কায়েদার শক্ত ঘাঁটি হিসেবে সেই সব এলাকা অনেক দিন থেকেই পরিচিত। তবে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণেই হয়তো সন্ত্রাসবাদী হামলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যও আবার হতে হচ্ছে পশ্চাদ্বর্তী সেই সব অঞ্চলকে, কেননা মানুষকে ভয় দেখিয়ে আধিপত্য বজায় রাখা হচ্ছে জঙ্গিদের একটি প্রধান কৌশল।
তাই দ্বিমুখী সেই ভীতিকর অবস্থার মধ্যে বসবাস করতে হওয়ায় দুই দিক থেকে আসা আঘাতেই চরম দুর্দশার মধ্যে পড়তে হচ্ছে সেখানকার লোকজনকে। অন্যদিকে তাঁদের সেই বঞ্চনা আর দুর্দশাকে পুঁজি করে প্রচারযুদ্ধে একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য চালিয়ে যাওয়া প্রচেষ্টায়ও অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছেন সেই এলাকারই কিছু মানুষ। এই দ্বিতীয় দলের মধ্যে থেকে মালালা ইউসুফজাই নামের বালিকাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দিয়েই কেবল বসে নেই প্রচারযুদ্ধের পশ্চিমের কান্ডারিরা, সেই বালিকাকে এখন বিশ্বের আনাচকানাচে পাঠিয়ে কতটা নির্মম সন্ত্রাসী জঙ্গিরা, তা প্রমাণের চেষ্টাও তারা সমানে করে চলেছে। সে রকম ঢাকঢোল পেটানো প্রচারের কল্যাণে তালেবান আর আল-কায়েদার অন্যায় আচরণের শিকার হওয়া ও সেই সঙ্গে নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক সাহসী বালিকা হিসেবে মালালার পরিচয় আমরা জেনে নিচ্ছি এবং বালিকার সাহসের কাহিনি পাঠ করে আবেগে আমরা হচ্ছি আপ্লুত।
তবে মালালার সেই বীরত্বের কাহিনি গল্পের পুরোটা নয়। সম্পূর্ণ সেই গল্পে আরও রয়েছেন বিশ্বজুড়ে নাম-পরিচয়হীন অনেক মানুষ, নেভাডার মরুভূমি থেকে উড়ে আসা হন্তারক দানবের হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাণপণে এদিক-সেদিক ছুটে যাওয়ার পরও নিজেদের জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হচ্ছেন যাঁদের অনেকে। পাল্লায় ভারী সেই অবহেলিত দলটিতে মালালার ঠিক বিপরীতে আছে প্রায় একই বয়সের অন্য এক বালিকা, নাম যার নাবিলা রেহমান।
গত বছরের নভেম্বর মাসে বাবার হাত ধরে নাবিলা এসেছিল জাপানে তার জীবনে ঘটে যাওয়া এমন কিছু মর্মান্তিক ঘটনার কথা জাপানবাসীকে জানাতে, মালালাকে নিয়ে মত্ত থাকার ডামাডোলে যার কিছুই আমরা সেভাবে শুনতে পাইনি। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে নাবিলার বয়স যখন ছিল ১২ বছর, পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সেই দিনটি সে বাড়িতেই কাটিয়েছিল, ঈদের আসন্ন প্রস্তুতি হিসেবে স্কুল বন্ধ থাকায় পরিবারের কাজে সাহায্য করছিল সে এবং কল্পনায়ও ভাবেনি বাড়ির আশপাশের নিরাপত্তা ভেদ করে আকাশ থেকে ছুটে আসা হন্তারক আঘাত হানবে তাদের সেই পুরো পরিবারের ওপর। সেটা ছিল ২০০২ সাল থেকে শুরু হওয়া এলাকার ওপর মার্কিন সামরিক বাহিনীর চালিয়ে যাওয়া অগণিত ড্রোন হামলার একটি, যে হামলায় নাবিলার বৃদ্ধা পিতামহী তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ হারান এবং নাবিলা ও তার এক বোনসহ আরও কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হন।
২০১২ সালের অক্টোবর মাসে চালানো সেই ড্রোন হামলার পরপর পলায়নপর পাঁচ জঙ্গির ঘটনাস্থলে ঘায়েল হওয়ার কথা মার্কিন সামরিক বাহিনী বিশ্ববাসীকে জানিয়ে অভিযানের সাফল্যের উল্লেখ করেছিল। তবে ঘটনা হচ্ছে, সেদিনের সেই হামলায় নিহত হয়েছিলেন পাঁচজন নয়, মাত্র একজন, আর তিনি হলেন নাবিলার মাতামহী। অন্য যে কয়েকজন এতে আহত হন, সেই দলে নাবিলাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সবাই তাঁরা সেদিন জড়ো হয়েছিলেন শসাখেতের ফলন তুলে আনতে, বন্দুক হাতে সন্ত্রাসী কোনো অভিযান চালাতে নয়। সে রকম এক নিষ্কলঙ্ক মুহূর্তেই তাঁদের ওপর আঘাত হানে প্রাণঘাতী ড্রোন।
জাপানের সমাবেশে নাবিলা সেদিন শুনিয়ে গেছে তার কৈশোরের স্বপ্নভঙ্গের কথা, আর সেই সঙ্গে আরও বলে গেছে নতুন যে স্বপ্ন সে এখন দেখছে, সে কথাও। নাবিলার নিজের বয়ানে তার সেই বক্তব্য ছিল এ রকম: ‘আমি খুশি যে (মালালা) ইউসুফজাই অত্যন্ত সম্মানিত একটি পুরস্কার পেয়েছে। এটা নিশ্চয় সুখবর, তবে আমি চাই যুদ্ধ যেন বন্ধ হয়। আমি আরও চাই সমাজ যেন শিক্ষিত হয়। আর এটাই হচ্ছে আমার চাওয়ার একমাত্র লক্ষ্য।’
সন্দেহ নেই, বালিকার চাওয়ার ব্যাপ্তি খুবই সীমিত। তবে আকাশজুড়ে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে যারা এখন বিশ্বের মোড়ল হিসেবে ছড়ি ঘোরানোর পাঁয়তারায় ব্যস্ত, সীমিত সেই চাহিদার দিকে কর্ণপাতের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বা কোনো রকম সময় তাদের একেবারেই নেই। ড্রোন হামলায় হতাহত সবার দেহে সন্ত্রাসী-জঙ্গি ছাপ মেরে দিয়ে কালক্ষেপণ না করে প্রচার করা তাদের সব বার্তা, সেই পরিষ্কার ইঙ্গিত আমাদের দিচ্ছে।
ধাতু আর কলকবজায় তৈরি রোবট যুদ্ধে ব্যবহার করা কতটা যুক্তিসংগত, রোবটের আবিষ্কারকেরা কিন্তু শুরু থেকেই নৈতিক সেই প্রশ্ন তুলে আসছেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূল লক্ষ্য মানবকল্যাণ হয়ে থাকলে রোবটের ব্যবহার কল্যাণকর কাজেই সীমিত থাকা উচিত। তবে সভ্যতার ইতিহাস আমাদের বলে দেয় যে যুদ্ধবাজরা মানবকল্যাণকে সব সময় নিজেদের সংকীর্ণ লক্ষ্যে কাজে লাগাতে তৎপর। ড্রোন নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা খেলাও হচ্ছে সেই ধারাবাহিকতারই একটি দিক, যা কিনা সাধারণ মানুষের জীবনকে করে তুলছে বিপর্যস্ত। ড্রোন বা চালকবিহীন বিমানও এক অর্থে হচ্ছে রোবট, মানুষের জীবন সহজ করে দেওয়ার জন্য নানা রকম কাজে যেটা ব্যবহার করা সম্ভব। তবে সমরবলে বলীয়ানরা অন্য যে স্বপ্ন এর মধ্য দিয়ে দেখতে শুরু করেছে তা হলো, পৃথিবীর বড় অংশকে নিজেদের বশংবদ করে রাখার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করতে জুতসইভাবে সেটাকে কাজে লাগানো। ঠিক সে রকম স্বপ্নই দেখেছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখক জুলে ভার্নের একটি উপন্যাসের খলনায়ক, পরিণতি হিসেবে নিজের পতন যে শেষ পর্যন্ত ডেকে আনে। নেভাডার মরুভূমির স্বপ্নচারীদেরও সেই একই পরিণতি এখন প্রত্যাশা করছে বিশ্বের বিবেকবান জনতা।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।