ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতির বক্তব্য নিয়ে একটি বিশ্লেষণ

মো. রহমত উল্লাহ
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ড. রহমত উল্লাহর বক্তব্য নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন বিতর্ক চলছে। কিন্তু খুব কম লোকই বক্তব্যটি স্বকর্ণে শুনেছেন। যাঁরা সেদিন মিটিংয়ে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মতামতের ক্ষেত্রে ‘তীব্র বিরোধিতা’, ‘মৃদু বিরোধিতা’, ‘কোনো বিরোধিতা নয়’—এ রকম নানা ধরনের প্রবণতা পরিদৃশ্যমান হয়।

অধ্যাপক রহমত উল্লাহ স্বয়ং ১৭ তারিখে মিটিংয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর ১৮ তারিখে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ঘটনার দিন তিনি কী বলেছিলেন, কতটুকু বলেছিলেন, তাতে কোনো ভুল ছিল কি ছিল না, তা তিনি প্রত্যাহার করে নিতে রাজি কি রাজি নন—এসব নিয়ে তিনি বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। এরপর আমরা ভেবেছিলাম, বিষয়টির সেখানেই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, স্বয়ং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা—সবাই পরবর্তী সময়ে ‘দোষী’ রহমত উল্লাহকে ‘শাস্তি’ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

এই ডামাডোলের মধ্যে খবরের কাগজে যে কথাটি বারবার নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা হচ্ছে ‘খুনি মোশতাকের প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতির শ্রদ্ধা।’
কিন্তু এতে আমরা অনেকেই বিস্মিত হয়েছি। এর কারণ, যাঁর সম্পর্কে এই অভিযোগ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুদিন ধরেই আওয়ামী লীগপন্থী নীল দল করে আসছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে তাঁর মূল পড়াশোনা সম্পন্ন হয়েছে। তিনি সেই ২০০৪ সালেই নীল দলের পক্ষ থেকে লেকচারার ক্যাটাগরিতে সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এখন তিনি ল ফ্যাকাল্টির অধ্যাপক এবং ল ফ্যাকাল্টির নীল দলের নির্বাচিত ডিনও বটে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী নীল দল কর্তৃক মনোনীত ও নির্বাচিত শিক্ষক সমিতির সভাপতিও হয়েছেন তিনি। আসলে শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবেই ১৭ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আয়োজিত মুজিবনগর দিবসে তিনি তাঁর সেই বিতর্কিত বক্তৃতাটি প্রদান করেন। প্রশ্ন ওঠা তাই স্বাভাবিক, কেন তিনি ওই বক্তৃতায় সর্বজনবিদিত খুনি মোশতাকের প্রশংসা করতে গিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার আওয়ামীপন্থী শিক্ষক হিসেবেই তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তাই খটকা লাগে, আসলেই তা সত্য কি না? সত্য হলে কতটুকু ‘ইচ্ছাকৃত সত্য’ এবং কতটুকু ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’?

এটাকে ইচ্ছাকৃত সত্য ধরে নিয়ে এর একটি তার মতো করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ড. সেলিম মাহমুদ, আইন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। ড. রহমত উল্লাহর বক্তব্যের পরদিনই ১৮ এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি লেখা ‘মুখোশধারীদের চিহ্নিত করা জরুরি’। এই প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি দাবি করেন, ‘এই দলীয় পরিচয়ের মুখোশধারীরাই খুনি মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শফিউল আলম প্রধানদের প্রেতাত্মা...পেশাদারি পরিচয়ের মুখোশধারী হোক আর দলীয় পরিচয়ের মুখোশধারী হোক এদের চিহ্নিত করতে হবে।’ পরে আমরা দেখলাম, এই চিহ্নিত করা ও শাস্তি প্রদানের অভিযান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে ড. রহমত উল্লাহকে তাঁর সব পদ ও একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাঁর অপরাধ ও শাস্তি নির্ধারণের জন্য একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। কোনো কোনো সংগঠন তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্য ক্ষমা চাওয়ার জন্য দাবি করেছে। আবার কেউ কেউ তাকে ক্যাম্পাস থেকে আজীবন বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন।

এসব নানামুখী অভিযানের ফলে রহমত উল্লাহ ও তাঁর পরিবারের ওপরেও নানা চাপ ও আতঙ্ক এসে ভর করেছে। কিছুদিন আগে তাঁর তিন মেয়ে রাতে অনিরাপদ বোধ করায় ভয় পেয়ে আমার স্ত্রীকে ফোনও করেছিল। যদিও পরে জানা গেল, ওই দিন বাড়ির আশপাশে ছাত্রলীগ কর্মীদের জমায়েতটি ছিল অন্য একটি নিরীহ কারণে। এখানে বলে রাখছি, ড. রহমত উল্লাহর কন্যারা আমার কন্যার বন্ধু এবং আমরা উভয়েই বর্তমানে শহীদ মুনীর চৌধুরী ভবনের বাসিন্দা এবং পরস্পর প্রতিবেশী। আমি বামপন্থী এবং তিনি আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের একজন নেতা, সেভাবেই আমাদের সম্পর্ক এবং সেই হিসেবেই তাঁকে চিনি ও জানি।

ড. রহমত উল্লাহর বিষয়টি বর্তমানে তদন্তাধীন। তার ওপর ড. রহমত উল্লাহ ইতিমধ্যে আত্মরক্ষার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। সুতরাং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য হয়তো আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। মৌলিক প্রশ্নটি হচ্ছে, আসলে সেদিন ড. রহমত উল্লাহ কী বলেছিলেন? এখানে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যগুলোর দিকে যদি তাকাই তাহলে নিম্নোক্ত চার ধরনের বক্তব্য পরিলক্ষিত হয়:

১. অনুষ্ঠানে শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে বক্তব্য দিতে এসে ড. রহমত উল্লাহ তাঁর লিখিত বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের চার নেতা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।’ (http://www.bd-pratiden.com/national/2022/04 / 17 / 76100)
২. ‘মুজিবনগর দিবসের এই আলোচনা সভায় ১৯৭১ সালেও মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অন্য মন্ত্রীদের পাশাপাশি তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুনি মোশতাকের কথা উল্লেখ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ।’ (http://www.barta24. net/special-report/ 182108)
৩. ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. রহমত উল্লাহ মুজিবনগর সরকারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ সামাদ। আর উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, রহমত উল্লাহর বক্তব্যের ওই অংশটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে অধ্যাপক রহমত উল্লাহ বলেছেন, তিনি মুখ ফসকে খন্দকার মোশতাকের নাম বলে থাকতে পারেন। সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।’
(দৈনিক প্রথম আলো, প্রতিবেদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ এপ্রিল ২০২২)

প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনে ভিসি ড. আখতারুজ্জামান ও ড. রহমত উল্লাহর আরও দুটি ব্যাখ্যামূলক উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ভিসি ড. আখতারুজ্জামান বলেছেন, ‘অধ্যাপক রহমত উল্লাহর বক্তব্যে খন্দকার মোশতাকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অংশটুকু প্রত্যাহার করা হয়েছে। (মোশতাকের নাম) এককভাবে নয়, আরও কয়েকটা নামের সঙ্গে বোধ হয় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন।’ এই প্রসঙ্গে ড. রহমত উল্লাহও বলেছেন, ‘মুজিবনগর সরকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে যদি স্লিপ অব টাং কিছু বলে থাকি তাহলে আমি দুঃখিত। ইতিহাস তো আমি তৈরি করিনি। মোশতাক বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। সে এই জাতির ভাগ্যের জন্য কলঙ্ক। তার প্রতি সম্মান জানানোর প্রশ্নই আসে না। আমি আমার বক্তব্যে তার প্রতি নিন্দা জানিয়েছি।’
(উৎস: প্রাগুক্ত)
৪. সর্বশেষ ভাষ্যটি দ্য ডেইলি স্টারের ভাষ্য। সেখানে বলা হচ্ছে,
‘সভাসূত্রে জানা গেছে, অধ্যাপক রহমত উল্লাহ বক্তব্য দেওয়ার সময় মুজিবনগর সরকার নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ সময় তিনি মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রণালয়ে যেসব মন্ত্রী ছিলেন তাঁদের নাম উল্লেখ করে তাঁদের শ্রদ্ধা জানান। একপর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের নামও উল্লেখ করেন তিনি। তবে শ্রদ্ধা জানানোর পর খন্দকার মোশতাকের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেও বক্তব্য দেন তিনি।’
(দ্য ডেইলি স্টার, এপ্রিল ২২, ২০২২)

এই চার ভাষ্যের পর লেখাটি আর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। তবে বর্তমানে রহমত উল্লাহ বাধ্য হয়ে মানহানির মামলা করেছেন বলে জানা যায়। বস্তুত তাঁর বক্তব্যটি যেহেতু তাঁর মতেই ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’, সেহেতু এটি এক্সপাঞ্জ করার মধ্য দিয়েই এই সমস্যার সহজ সুন্দর নিষ্পত্তি হতে পারত। তবু সর্বশেষ আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব ১৮ তারিখ অর্থাৎ ঘটনার পরদিন রহমত উল্লাহ যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, সেই সম্মেলনে প্রদত্ত তাঁর সর্বশেষ কথাগুলোর প্রতি। তিনি সেখানে বলেছিলেন, ‘গতকালের আলোচনা সভায় বক্তব্য প্রদানকালে আমি যদি অজ্ঞতাবশত কোনো শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করে থাকি, তা নিতান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত ভুল। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। একই সঙ্গে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে যেন কোনো ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি সৃষ্টি না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী সকলের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এরপরও তাঁকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করাটা কি আদৌ ঠিক হবে?

এম এম আকাশ অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক