ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আর কত নিচে নামাব আমরা?

অনেক পণ্ডিত ও বিদগ্ধজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অধিক কিছু’ বলে থাকেন। কারণটি এই যে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ ভূখণ্ডে শিক্ষার বিস্তার, শি‌ক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ও বাঙালি জাতি গঠনে অবদান রাখার মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি কিছু’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যিনি সত্যেন বোস নামে পরিচিত, একটি প্রবন্ধ পাঠান। তাঁর ওই প্রবন্ধ পড়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার মতে বসু কর্তৃক প্ল্যাংক-সূত্র নির্ধারণের এই পদ্ধতিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’


ঢাকায় একসময়ে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী এক গবেষক দল, যারা মৌলিক পদার্থের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। এসব গবেষণায় অংশগ্রহণ করেছিলেন কে এস কৃপাণ, এস আর খাস্তগির, কাজী মোতাহার হোসেন এবং আরও অনেকে। এটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষকদের প্রকৃত পরিচয়, সত্যিকারের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের জন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগন্নাথ হলে বসে লিখতে পেরেছিলেন: ‘এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায়...’ (অধ্যাপক এ এম হারুন-অর-রশীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব স্যুভেনির, ২০১২।)

যে বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে খ্যাত ছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয় আজ এশিয়ার প্রথম ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই কেন এবং বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যে র‌্যাঙ্কিং হয়, ওই র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৭০০ স্তরের পরে কেন, সেই প্রশ্নটি করা কি আজ অবান্তর হবে? সিনেটের অধিবেশনে উপাচার্য নিয়োগের জন্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মধ্যে যে দ্বিধাবিভক্তি লক্ষ করা গেল; শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যে ন্যক্কারজনক ধস্তাধস্তি পুরো জাতি অবাক হয়ে অবলোকন করল, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান শিক্ষক হিসেবে আমার প্রশ্ন, এ লজ্জা আমরা কোথায় রাখব? আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আর কত নিচে নামাব?

দুই.
গত ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে নীল দল থেকে দুটি প্যানেল জমা পড়ে (যদিও সেটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে); অর্থাৎ নীল দল থেকে ৭০ জন শিক্ষক মনোনয়নপত্র জমা দেন, পরে একজন শিক্ষক তাঁর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু নীল দলের একটি প্যানেলের ৩৫ জনের মনোনয়ন নির্বাচন কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ যেভাবে কোনো নিয়ম–নীতির তোয়াক্কা না করে বাতিল করে দেন, সেটি ছিল আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। আইনের একজন ছাত্র হিসেবে তখনই আমার মনে হয়েছিল, ২২ মে সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। (যেসব শিক্ষকের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছিল, তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পরে তাঁরা নিবৃত্ত হন।) যথেষ্ট আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসু থাকার পরও নানা ব্যস্ততার কারণে এ ব্যাপারে আমার আইনি অনুসন্ধান আমি চালাতে পরিনি। তবে ২২ মে সিনেটের ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধির যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ওই দিন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোয় একটি উপসম্পাদকীয় লেখেন, যার শিরোনাম ছিল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট নির্বাচনের নয়া মডেল’।

ওই উপসম্পাদকীয়তে জনাব খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি গণতন্ত্রের সূতিকাগার হয়, তাহলে সেই সূতিকাগারে আজ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি অভাবনীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ৩৫ বৈধ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র অস্বীকার করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইনের কোন ধারা বলে ব্যালট পেপারে তাঁদের নাম থাকবে না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ১০৬ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন, যাঁরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি, তাঁরা প্রত্যেকে বৈধ প্রার্থী। কিন্তু বৈধ প্রার্থীর তালিকায় ওই ৩৫ জনের নাম নেই।’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট নির্বাচনের নয়া মডেল goo.gl/EgWGxK) জনাব খানের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি। তখনই আমরা এই নির্বাচন নিয়ে রিট মামলাসহ নানা ধরনের জটিলতার আশঙ্কা করেছিলাম, যা এখন বিভিন্ন ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জাকর ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।

তিন.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সিনেটে সম্প্রতি উপচার্য়ের প্যানেলের তিনটি নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সিনেট আইনগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ এবং নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, প্রথমত ২২ মের সিনেটের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, যার বিস্তারিত আলোচনা মিজানুর রহমান খানের লেখায় পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকার পরও দীর্ঘ আট মাসেও ওই নির্বাচন করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি ইচ্ছাকৃতভাবেই। রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি না থাকায় ১০৫ জনের সিনেটে ২৯ জুলাইয়ের অধিবেশনে ৫০ জনের মতো সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ফলে এই সিনেটের গঠন ক্রটিপূর্ণ। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ডিভিশন ১৫ জন রিট আবেদনকারীর আবেদনের জবাবে ২৪ জুলাই রুল জারি করেন এবং ২৯ তারিখের সিনেট অধিবেশন স্থগিত করে দেন, যদিও ২৭ জুলাই আপিল বিভাগের চেম্বার জজ ২৯ জুলাইয়ের অধিবেশেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। তবে ৬ আগস্ট বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হবে বলে প্রত্যাশা করছি।

অর্ধেকের কম সদস্য নিয়ে যে সিনেটে উপাচার্যের প্যানেল হয়, তাকে কি সমর্থন করা যায়? দ্বিতীয়ত, বিরোধী দল অর্থাৎ সাদা দলের শিক্ষক প্রতিনিধিরা (তাঁরা সংখ্যায় ২ জন হলেও গণতান্ত্রিক চর্চায় তাঁদেরও গুরুত্ব রয়েছে) যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে অধিবেশনটি বর্জন করেছেন। তৃতীয়ত, প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি, অর্থাৎ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি না থাকা এবং ডাকসু না থাকায় বর্তমান শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি বর্তমান সিনেটকে উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের উপাচার্য হওয়ার হাতিয়ারে পরিণত করেছে, ফলে এটি নৈতিক মানদণ্ডে গ্রাহ্য নয়, আর ওই একই কারণে এটি সমর্থন করারও কোনো সুযোগ নেই।

চার
দীর্ঘ দিনের একটি ধারণা ছিল যে, সারা বাংলাদেশ অন্ধকারে তলিয়ে গেলেও যেখানে টিম টিম করে আলো জ্বলে, সেটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সামরিক শাসনের সময় হোক বা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শাসন চলেছে, অব্যাহত থেকেছে মুক্তবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক চর্চা। কিন্তু ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে উপাচার্যের পদ আঁকড়ে থাকার মানসিকতার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের যে ব্যত্যয় হল, নৈতিকতার যে অধপতন হল, সেটি দুর্ভাগ্যজনক, লজ্জাস্কর ও মর্মান্তিক। আমরা এ থেকে পরিত্রাণ চাই। আমরা মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে চাই যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন হয়ে ওঠে শিক্ষা ও গবেষণার প্রাণকেন্দ্র, প্রায় ১০০ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন হয়ে ওঠে মুক্তচিন্তা ও বহুত্ববাদের প্রকাশ ও বিকাশের পীঠস্থান।

শেখ হাফিজুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।