ঢাকার বাসযোগ্যতার দিকে নজর কে দেবে

বিশ্বের বাস-অযোগ্য বড় শহরের তালিকায় আমাদের অবস্থান প্রায় শীর্ষে

বাসায় একচিলতে বারান্দা আছে। সকালে বসে চা খেতাম, মাঝেমধ্যে বিকেলে বসে রেডিও শুনতাম। বাসাটা আছে, বারান্দাটাও আছে; কিন্তু এখন চা খেতে, রেডিও শুনতে দরজা-জানালা বন্ধ করে একটা রুমের ভেতর বসি। বারান্দায় বসলে হরেক রকম যানবাহনের যান্ত্রিক আর বড় বড় পাজেরো গোছের গাড়ির হর্ন নামক দানবীয় শব্দে কয়েক মিনিটেই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ি। এসব গাড়িতে প্রায়ই দেখি ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগানো। আজকাল বোধ হয় গাড়িতে হরেক রকমের পতাকা লাগানো কর্মকর্তাদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেছে। নয়তো অনেকেই প্রতারণার জন্য বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভয় দেখানোর জন্য ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড গাড়িতে জুড়ে দেন। কয়েক মাস ধরেই নতুন একধরনের অ্যাম্বুলেন্সের বিকট সাইরেনের সঙ্গে ঢং ঢং করে স্কুলের ঘণ্টার মতো শব্দে পিলে চমকে যাচ্ছে।

কোভিড শুরুর পর থেকে দেশের বাইরে যাইনি। শেষ গিয়েছিলাম ২০১৯ সালের শেষের দিকে ব্যাংককে। চার থেকে পাঁচ দিন ব্যাংককের এপথে-ওপথে বেশ ঘোরাঘুরি করতে হয়েছিল। হিসাব রেখেছিলাম, পাঁচ দিনে কুল্লে তিনবার রাস্তাঘাটে সাইরেনের শব্দ শুনেছিলাম। তিনটাই ছিল পুলিশের গাড়ি। কোনো অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনিনি। হর্নও শুনিনি কোনো। স্পষ্টতই ওই দেশের লোকের কোনো তাড়াহুড়া নেই। ট্রাফিক জ্যাম থাকলে তারা মনে করে না যে বিকট হর্ন বাজালে রাস্তা খালি হয়ে যাবে। সেই শহরে সম্ভবত জরুরি চিকিৎসার কারও প্রয়োজন পড়ে না। হাসপাতাল নিঃসন্দেহে আছে প্রচুর।

আমরা প্রায় সবাই জানি যে বায়ুদূষণে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বড় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা প্রথম হলেও দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে বলতে গেলে প্রতিবছরই দখলে রাখে। ওয়াসার সেবা যাঁরা গ্রহণ করেন, তাঁরা কেউ আর সাংঘাতিক পানিদূষণে বিচলিত হন না। নদ-নদী ও খাল-বিলের কথা না হয় বাদই দিলাম, শব্দ, বায়ু ও পানিদূষণের মাপজোখের অনেক বৈজ্ঞানিক পন্থা আর হিসাব আছে। এসব হিসাব-নিকাশ যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা করে, তারা অনবরতভাবে দূষণমাত্রায় আমাদের শীর্ষে অথবা প্রায় শীর্ষে রাখে। বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক হিসাব অনুযায়ীও আমরা প্রায় শীর্ষেই আছি। অর্থাৎ, বিশ্বের বাস-অযোগ্য বড় শহরের তালিকায় আমাদের অবস্থান প্রায় শীর্ষে। ১৭২টি বড় শহরের মধ্যে আমাদের ঢাকা শহর থেকে আরও নিকৃষ্ট শহর আছে মাত্র ছয়টি, যেমন দামেস্ক আর ত্রিপোলি; যেখানে নৃশংস গৃহযুদ্ধ চলছে প্রায় এক যুগ ধরে। আমাদের সান্ত্বনা পুরস্কার হলো পাকিস্তানের করাচিও ঢাকার নিচে।

আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশন, অর্থাৎ ফিফার ফুটবল খেলুড়ে দেশের তালিকায় আমাদের বর্তমান অবস্থান ১৯২তম। অর্থাৎ, বিশ্বের ১৯১টি দেশ আমাদের থেকে ভালো ফুটবল খেলে। তবে এখানেও আমরা সেই একই সান্ত্বনা পেতে পারি। পাকিস্তানের অবস্থান আমাদের নিচে, ১৯৬তম।

২.

হয়তো পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বাসযোগ্যতার সঙ্গে ফুটবল র‌্যাঙ্কিংয়ের কী সম্পর্ক? সম্পর্কটা খুবই সোজাসাপটা। খেলার মাঠ নেই, তাই ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী। যে কটা মাঠ ছিল, তার বেশির ভাগই বেদখল। মাস্তান-অবশ্য এখন আর রাখঢাক না করে মাস্তানের পরিবর্তে ক্রিমিনাল গ্যাং বা অপরাধী চক্র ব্যবহার করাই বেশি বাস্তব, তারা এসব মাঠ বেশির ভাগই দখলে নিয়েছে। টিভি চ্যানেলের সংবাদে দেখেছি সে মাঠগুলোতে এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়, থানার জব্দ করা ভাঙাচোরা বাস-ট্রাক ফেলে রাখা হয়েছে মাসের পর মাস। আর আছে অপরাধী চক্রের অস্থায়ী বা স্থায়ী দোকান-মার্কেট। আমাদের মতো ক্রমে হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের দেশগুলোতে দখলদারি এবং তার চেয়েও বড় বড় অপরাধ প্রায়ই সংঘটিত হয় অপরাজনীতি, আর হরেক গোছের কিছু কিছু আমলার ছত্রচ্ছায়ায়। পৃথিবীর অন্যান্য হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের দেশে যা হয়, আমাদেরও প্রায়ই সেটাই হচ্ছে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তরে বহু কিলোমিটারব্যাপী যে উত্তরা নামক মডেল টাউন, সে টাউনে নাটকের কোনো মঞ্চ নেই, সিনেমা হলও সম্ভবত একটিও নেই, সাংস্কৃতিক আয়োজনের খবর পত্রিকায় পড়েছি বলে মনে পড়ে না। বাড্ডা-রামপুরা, খিলক্ষেত, পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি-লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর, বিশাল মিরপুর বা অতি অভিজাত গুলশান—কোথাও সাংস্কৃতিক বিনোদনের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, আছে বলে শুনিওনি। অবশ্য মিরপুরে আছে জাতীয় চিড়িয়াখানা। তবে ঢাকার ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে বিনোদনের একটা অতি উৎকৃষ্ট স্থান আছে—গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক।

ঢাকার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় প্রথম আট শ-নয় শ বা এক হাজারের মধ্যে থাকার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে।

এটা নিশ্চিত যে এ দেশে যোগ্য নগরবিদ, পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশ সংবেদন বিশেষজ্ঞ, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, পরিবেশ গবেষক, সবই আছে অঢেল। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার আর নেই, কিন্তু তাঁর যোগ্য উত্তরসূরিরা আছেন। তাঁদের কাজে লাগাতে হবে।

৩.

স্পষ্টতই মেগা প্রকল্প দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান হবে না। ২০ থেকে ৩০ বা সে বয়সে যেসব তরুণ-যুবা ঢাকা শহরে বেড়ে উঠছে, বসবাস করছে, কাজকর্মে ব্যস্ত বা বেকার, তাদের গড় আয়ু হয়তো বর্তমানে ৭২ বছরের গড় আয়ুর ধারেকাছেও যেতে পারবে না। এসব দূষণের কারণে ৫০ পেরোতেই তাদের জীবনপ্রদীপ ধুঁকে ধুঁকে, নিবু নিবু করে হয়তো কিছু বছর চলবে। যাদের অর্থসম্পদ সঞ্চিত হবে, তাদের কল্যাণে চিকিৎসা ব্যবসায় থাকবে বহু বছর ধরে রমরমা অবস্থা।

গত ২৯ জুন পত্রিকায় দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বন্যাকবলিত হাওর এলাকায় এখন থেকে ব্রিজ আর ওভারপাস হবে, সড়ক হবে না। তাহলে এত দিন কেন হাওর বা তার আশপাশের এলাকায় এত সড়ক বা বাঁধ বানানো হলো, যে কারণে বন্যাপীড়িত জনমানুষের দুর্ভোগ বহুলাংশে বেড়ে গেছে। সঠিক সিদ্ধান্ত যদি কেবল প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হয়, তাহলে আমাদের করের টাকায় এত সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা অধিদপ্তর আমরা কেন পুষছি?

অবশ্য তাদের একটা দক্ষতা ও পারদর্শিতা অতুলনীয়। তৈলমর্দন। এর অধিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।

তৈলমর্দন বিদ্যা সব সময় বা সর্বক্ষেত্রে যে খারাপ, সেটা অধমের বক্তব্য নয়। এই বিদ্যারও প্রয়োজন আছে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাকে ১৬৬তম স্থান থেকে টেনে তুলে অন্তত ১১০ বা ১২০তম স্থানে নিয়ে আসতে পারলে আমরা সবাই বর্তে যাব। এটা নিশ্চিত যে এ দেশে যোগ্য নগরবিদ, পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশ সংবেদন বিশেষজ্ঞ, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, পরিবেশ গবেষক, সবই আছে অঢেল। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার আর নেই, কিন্তু তাঁর যোগ্য উত্তরসূরিরা আছেন। তাঁদের কাজে লাগাতে হবে।

বায়ু, শব্দ ও পানিদূষণ সবচেয়ে বেশি এবং সরাসরি যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত এবং ভুক্তভোগী, ঢাকা শহরের সেই ১৫ লক্ষাধিক রিকশাচালককে এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সবচেয়ে দূষিত রাস্তাগুলো দিয়ে তাঁরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহরটা সচল রাখছেন এবং যাঁদের আয়ু এই দূষণের কারণে সম্ভবত ৫০ পেরোবে না, তাঁদের দুঃখের কথাও শুনতে হবে। এই দেশ একটা কল্যাণকর রাষ্ট্র হলে আমার প্রস্তাব হতো—পেনশনের ব্যবস্থাটা সবার আগে তাঁদের জন্যই করতে হবে। যাঁরা এসি গাড়িতে বসে আর বিমানের ফার্স্ট ক্লাসে চড়ে অহরহ বিদেশ যান, চিকিৎসার জন্য যান ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর এবং রাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি দক্ষিণা উপভোগ করেন, তাঁদের বাদ দিয়ে এই ১৫ লাখ রিকশাচালকের পেনশনের কথা ভাবতে হবে প্রথমেই। যে শিশু-কিশোরেরা খেলাধুলাবিহীন একটা বিষময় জগতে বেড়ে উঠছে, তাদের কথা শুধু ভাবলেই চলবে না, কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে হবে।

স্বপ্ন দেখি এবং আমরা সবাই দেখতে চাই। কিন্তু ভয় হয়, শঙ্কা হয় যে অনেক ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের দেশের মতো আমরাও ক্রমে খপ্পরে পড়ে যাচ্ছি অপরাধী চক্রের। এই চক্রের বিকট থাবা থেকে বেরিয়ে বসবাসযোগ্য ঢাকা করা হয়তো ইতিমধ্যেই একটা অসম্ভব স্বপ্ন হয়ে গেছে। তবে সুখী হব, যদি আমার বিশ্লেষণ সঠিক না হয়!

শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক