ঢাকার বায়ু ভালো হবে কবে?

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ঢাকার অবস্থা শোচনীয়। অপরিষ্কার, বসবাসের অনুপযোগী, অপরিচ্ছন্ন, দূষিত ও অসুখী শহরের তালিকার শীর্ষ সারিতে আমাদের রাজধানী শহর। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসুবিধা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, শিল্পায়ন, অবকাঠামোসহ ৩০টি মানদণ্ডের বিবেচনাতেও তলানিতে রয়েছে ঢাকা।

জনবসতি ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা। সরকারি হিসাবে ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৬ হাজার মানুষ বসবাস করলেও আসল সংখ্যাটা আরও বড়। হাজারো মানুষ প্রতিদিন ঢাকায় আসছেন শিক্ষা ও জীবিকার সন্ধানে। সরকারি অফিস, আদালত, ব্যাংক, পোশাক কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকামুখী হওয়ায় আজকে এ অবস্থা। জাতিসংঘের হ্যাবিটেট প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার রাস্তাঘাট, যানজট, গ্যাস বা ওয়াসার পানির ব্যবস্থা কোনটিই মেগাসিটির মতো নয়। এর ফলে বাড়ছে মাটিদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ ও বায়ুদূষণের হার। নগরে বায়ুদূষণের হার যেভাবে বাড়ছে, নগরবাসীর জীবনে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর চতুর্থ কারণ বায়ুদূষণ। মানুষের গড় আয়ু প্রায় তিন বছর কমে যাচ্ছে শুধু বায়ুদূষণের কারণে। দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে কেবল বায়ুদূষণের কারণে, যার মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)-এর ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যাওয়া শতকরা ৪৯ ভাগ শিশুই শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর বাতাসে সাধারণত ধুলা ও দূষণ বেড়ে যায়। ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা সম্পর্কে জানা যায় আন্তর্জাতিক গবেষণা থেকে। গত কয়েক বছরে বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকার অবস্থান প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর বায়ু ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন বিপজ্জনক ছিল। ২০১৫ সালে দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিনে। পর্যায়ক্রমে ২০১৬ সালে ১৯২ দিন, ২০১৭ সালে ২১২ দিন, ২০১৮ সালে ২৩৬ দিন, ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন ঢাকার বায়ু দূষিত ছিল, যার ধারাবাহিকতায় ২০২০ ও ২০২১ সালে বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।

বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘দেশের অভ্যন্তরে ইটভাটা, শিল্পকারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কালো ধোঁয়া, বস্তির প্রায় ৪০ লাখ চুলার আবর্জনা, কাঠ-কয়লা ও কেরোসিন দিয়ে রান্নার ধোঁয়া, ঢাকার বাইরে থেকে আসা হাজার হাজার ট্রাক ও দূরপাল্লার যানবাহনের ধুলা ও ধোঁয়া এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের ধুলার পাশাপাশি আন্তসীমান্ত বায়ুদূষণের জন্য এখানকার বায়ু দূষিত হয়ে থাকে।’

অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে, মানা হচ্ছে না কোনো নিয়ম। খোলা জায়গায় রাখা হচ্ছে ধুলাবালু, সিমেন্ট। এর ফলে সেখান থেকেও প্রচুর পরিমাণে ধুলাবালু বাতাসে মিশছে। প্রশাসনের নজরদারির অভাবও যে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্ট একাধিকবার হতাশা প্রকাশ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সচিব ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে তলব করেছিলেন।

বায়ুদূষণ রোধে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হলেও কোনো সুফল মেলেনি। বায়ুদূষণ কেবল একটি সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার প্রভাব পড়ছে সমগ্র বিশ্বের ওপর। বায়ুদূষণের ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তর পাতলা হয়ে যায়, পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়—যা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে যার ফলস্বরূপ বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ দাবানল, অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কেবল সচেতনতাই এই ভয়াবহ সংকটের গতিকে হ্রাস করতে পারে। তাই নিজেদের অবস্থান থেকে সবাইকে বায়ুদূষণ রোধে এগিয়ে আসতে হবে।

নুসরাত জাহান
শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়