তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা আর সেই শিশুটি

.
.

গণমাধ্যমে আলোচিত সাম্প্রতিকতম ঘটনা দিয়েই শুরু করছি। পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেছেন পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ও তাঁর সহযোগী। ঘটনাটি ঘটেছে দিনাজপুরের এক ছোট শহর পার্বতীপুরে। গত সপ্তাহে শিশুটিকে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়, তখন তাকে দেখে আঁতকে ওঠেন কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা। শিশুটির গাল, গলা, হাত, পায়ে ধারালো অস্ত্রের দাগ। ঊরুতে সিগারেটের ছ্যাঁকা। মাথায় ক্ষত। অচেতন শিশুটিকে ঠিক কীভাবে চিকিৎসা দেবেন, ভেবে উঠতে পারছিলেন না চিকিৎসকেরা। মেয়েটি অচেতন, তবু শুনেছি বেঁচে আছে। কী আশ্চর্য তার বেঁচে থাকার শক্তি!
বেঁচে উঠছেন মাত্র কয়েক দিন আগে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে অচেতন পড়ে থাকা খাদিজা আক্তার নার্গিস। পত্রিকার পাতাজুড়ে এসেছে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজাকে কোপানোর খবর। সংবাদপত্র লিখেছে, ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে খাদিজাকে কুপিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক বদরুল আলম। বদরুল ছাত্রলীগের নেতা বলে এই দুঃসাহস করেছেন, নাকি এটি কেবলই একজন প্রেম-প্রত্যাখ্যাত যুবকের প্রতিহিংসা চরিতার্থতা—এসব নিয়ে যখন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক তোলপাড় চলছে, তখন মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনে ফিরছেন তিনি।
মিরপুর সাইক পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী আফসানা ফেরদৌস অবশ্য বাঁচতে পারেননি। পত্রিকায় পড়েছিলাম, পুলিশ হাসপাতাল এলাকার সিসি টিভি ফুটেজ জব্দ করেছে। এই ফুটেজের সূত্র ধরেই নাকি মামলাটির ফয়সালা করা যাবে। অথচ অভিযোগ রয়েছে, সন্দেহভাজন হিসেবে তেজগাঁও কলেজের ছাত্রলীগের যে নেতার নাম বলা হচ্ছে, তার পরিবার থেকে কখনো টেলিফোনে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, কখনো–বা অজানা ফোন থেকে ‘বাড়াবাড়ি না করা’র হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তারপর কী হলো, সেই উত্তর পাওয়ার আশা ক্ষীণ।
ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসাকে স্কুলের সামনের পদচারী-সেতুতে যে যুবক ছুরিকাঘাত করেছে, তার দোকান থেকে রিসা পোশাক বানিয়েছিল। ছুরিকাঘাত করার তিন দিন পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রিসার মৃত্যু হয়। প্রাণবন্ত এক কিশোরীকে কেউ চাইলেই বিরক্ত করতে পারে, এবং প্রত্যাখ্যাত হলে খুনও করতে পারে! পত্রিকায় পড়েছি, সন্দেহভাজন ওবায়েদকে ধরিয়ে দিয়েছেন এক মাংসবিক্রেতা।
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ সেনানিবাস এলাকায় পাওয়ার পরে দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ উঠেছিল, তাতে আশাবাদী হয়েছিলাম, এবার হয়তো কিছু একটা হবে। কিন্তু না, ধর্ষিত হয়েছিল নাকি হয়নি, তনুর মৃতদেহ থেকে এই আলামত পরীক্ষার চেষ্টা ছাড়া তেমন কোনো ফলাফল আজও পাওয়া যায়নি। সেনাবাহিনী আমাদের নিরাপত্তার প্রতীক। সেনা এলাকায় ঘটে যাওয়া এমন ঘটনার বিচার হওয়াটা প্রতীকী অর্থেও ছিল অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত।

দুই.
গণমাধ্যমের তত্ত্ব বলে, কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি সেই বিষয় সম্পর্কে মানুষের সংবেদনশীলতাকে ভোঁতা বানিয়ে ফেলে। যেমন টেলিভিশনে যুদ্ধের ছবি দেখতে দেখতে যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের সংবেদনশীলতা আর কাজ করে না। এসব নির্যাতন দূরের কোনো বিষয় নয়। ঘরে ঘরে তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা আর মেয়েশিশুরা রয়েছে। কাজেই অন্য যে কারণটি জোরালো বলে মনে হয় তা হলো, কোথাও সাহায্য নেই ধরে নিয়ে কেবল নিজের ঘরের মেয়েটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকেই সবার মনোযোগ নিবদ্ধ। রয়েছে শ্রেণি প্রশ্ন। এ ধরনের নির্যাতন প্রান্তিক নারী বা শিশুর ক্ষেত্রেই মূলত ঘটেছে এতকাল।
তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজাদের মতো মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের মেয়েদের ওপর সরাসরি আঘাত অপেক্ষাকৃত নতুন। প্রতিবাদ কেমন হলে কার্যকর হবে, সেটিও বোঝা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।

তিন.
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল অন্তত দুই লাখ নারীর নির্যাতন অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে। যে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা হেঁটে চলে বেড়াই, নিশ্বাস নিই, কবিতা পড়ি, জাতীয় সংগীত গাই, সেই দেশের নির্মাণে এসব নারীর অংশীদারত্ব শুধু নয়, ভয়াবহ আত্মত্যাগ রয়েছে। পুরুষের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে। বাড়ি ফিরেছিলেন তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। সম্মান পেয়েছেন, ক্ষমতা পেয়েছেন। সব মুক্তিযোদ্ধার প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করা যায়নি সত্য, তবে তাঁদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত। কিন্তু যুদ্ধ শেষে নির্যাতনের শিকার নারীরা সম্মান পাননি। অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন। হারিয়ে গেছেন। অনেকে ইতিহাসের আগুন বুকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন। অনেকের যুদ্ধ আজও শেষ হয়নি। আজ যখন সফলভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হচ্ছে এবং রায় কার্যকর হচ্ছে, সেই যুদ্ধাপরাধীদের ভয়াবহ নির্যাতন ইতিহাসের মধ্যে বারবারই নারী নির্যাতনের কথাটি অনিবার্য সাক্ষ্য হিসেবে উঠে আসছে। এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং নারীর আত্মত্যাগ আর নির্যাতনের ইতিহাসকে তাই আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা দেশে নারীর জন্য মুক্ত পরিসর আজও নির্মিত হলো না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পোস্টারে মুদ্রিত হয়েছে, ‘বাংলার মায়েরা মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’। সেসব মুক্তিযোদ্ধা নারীর উত্তরসূরি মেয়েরা আজও নিরাপদ নয় স্কুলে যাওয়ার পথে, রাস্তায়, শিক্ষাঙ্গনে, পরিবারে, বর্ষবরণে টিএসসিতে, বইমেলায়, সিনেমা হলে, বাজারে, প্রেমিকের কাছে, সাইবার পরিসরে, সমতলে কিংবা পাহাড়ে। ধর্ষণ আর খুন যেন প্রতিকারহীন পরাভব হয়ে উঠছে যেকোনো নারীর জন্য, বিশেষভাবে মেয়েশিশুর জন্য।

চার.
প্রশ্ন হলো, সরকার কী করছে? রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে? সরকারি কার্যক্রম কি কেবল কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেই ঘটনার তদন্ত-আশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি মেয়েশিশুদের নিরাপত্তার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে? সব ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। কিন্তু এটিই একমাত্র চাওয়া নয়। জীবন ও সম্ভাবনার এহেন অপমৃত্যুর পাশে কোনো শাস্তিই যথেষ্ট নয়। শাস্তির পাশাপাশি মেয়েদের জন্য জীবনের সব স্তরে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলার কার্যকর সক্রিয়তা কাম্য। গ্রামের কত মেয়ের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায় শুধু স্কুলপথের নিরাপত্তাহীনতার জন্য! কত হাজারো মেয়ের বাল্যবিবাহ হয় শুধু এই নিরাপত্তাহীনতার ভীতি থেকে!
ছেলেশিশু বড় হয় আর তার বিচরণ-পরিধি বাড়তে থাকে, মেয়েশিশু বড় হয় আর তার নিরাপত্তাহীনতা ভয়ের চাদর হয়ে ঘিরে থাকে তাকে। মেয়েশিশুদের এই নিরাপত্তাহীনতায় বাঁচতে বাধ্য হওয়া তাদের মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। সরকার ও সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে মেয়েশিশুদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। মেয়েশিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের জীবন বিকাশের পূর্বশর্ত। তাদের অরক্ষিত রেখে কোনো উন্নয়ন সম্ভব বলে বিশ্বাস করি না। প্রয়োজনে জাতীয় কনভেনশন ডাকা হোক করণীয় নির্ধারণের জন্য। এই অবস্থার অবসান হতেই হবে।
তনু-রিসা-আফসানা-খাদিজা আর সেই পাঁচ বছরের মেয়েটির ঘটনা এই দেশের ভয়াবহ নারী নির্যাতনের কয়েকটি প্রকাশিত উদাহরণমাত্র। এমন অসংখ্য মেয়েশিশুর নির্যাতন-অভিজ্ঞতা অপ্রকাশিত। অত্যন্ত ভারী হয়ে ওঠা এসব নির্যাতন-অভিজ্ঞতার ওপর এখন এ দেশের সব মেয়েশিশুর নির্বিঘ্নে চলাফেরার পরিবেশ নিশ্চিত হোক। এ এক যুদ্ধ—এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে দেশ কী ভাবছে, আদৌ ভাবছে কি না, সেই প্রশ্নে থমকে আছে আমাদের আগামী।
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।