তবুও আমরা আশা হারাতে চাই না

উত্তেজিত জনতার দেওয়া আগুনে বসতঘরের সঙ্গে পুড়েছে রিকশাভ্যান। এখনো সেখানে পড়ে আছে পুড়ে যাওয়া রিকশার অবকাঠামো। সেই রিকশার অবকাঠামো সরানোর চেষ্টা করছেন নন্দ রানী। বুধবার দুপুরে তোলা
ছবি: আলতাফ হোসেন

আবারও প্রমাণিত হলো, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা কখনোই সংখ্যাগুরুদের ধর্ম নিয়ে কোনো উসকানিমূলক কাজ করেননি। কেননা এর বিপদ কী ভয়াবহ হতে পারে, তা তাঁরা জানেন। রামুতে বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুক আইডি থেকে যে পোস্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল, পরে দেখা গেছে সেটি ছিল ভুয়া। ওই যুবক কোনো পোস্ট দেননি। নাসিরনগরেও যে হিন্দু যুবকের পোস্ট নিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো, পরে জানা গেল সেই যুবক পোস্ট দেবেন কি লেখাপড়াই জানেন না।

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, এবারে কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখে গিয়েছিলেন ইকবাল হোসেন নামের এক যুবক। তাঁর পরিচয় জানলেও বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এর আগে বলেছেন, ওই যুবক বারবার তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করছে বলেন তাঁকে ধরা যাচ্ছে না।

আশা করি, ওই যুবক গ্রেপ্তার হলে পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলার রহস্য উন্মোচিত হবে। ওই যুবক চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত নানা রকম গুজব ডালপালা মেলেছিল; রাজনৈতিক দলের নেতারা একে অপরকে দায়ী করেছিলেন এবং ভবিষ্যতেও করতে থাকবেন। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারছেন না, এখন বিতর্কের চেয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা দেওয়া, আক্রান্ত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানো এবং অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা বেশি জরুরি। এ ঘটনা নির্বাচনী রাজনীতিতে কার কতটা লাভ বা ক্ষতি হলো সেসব নিয়েও হিসাব–নিকাশ করার ঢের সময় পাবেন। আপাতত এসব বাদ দিয়ে সংখ্যালঘুদের দুঃখমোচনের চেষ্টা করুন। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১২ বছরে বহির্বিশ্বে দেশের যে সুনাম ও খ্যাতি অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করে, এই এক ঘটনায় তা ম্লান হয়েছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ভারতের বিজেপি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিগ্রহের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

সরকারকে একটি বিষয় স্বীকার করতে হবে যে রাজনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর তাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকার পরও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে পারেনি; সংখ্যালঘুদের অনেক এবং পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা হয়েছে, প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে, আক্রমণ করা হয়েছে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও।

নোয়াখালীতে দুর্বৃত্তদের হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুজন খুন হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের একজন যতন সাহা, যাঁর চার বছরের একটি শিশুসন্তান আছে। নাম আদিত্য সাহা। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে কাঁদছে আর বলছে, ‘বাবা ফিরে এলে ভাত খাব। বাবা ফিরে না আসা পর্যন্ত কিছু খাবে না।’ যতনের স্ত্রী–সন্তানকে কী সান্ত্বনা দেবেন? পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তিনি নিজেই ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। সাম্প্রদায়িক হিংসা নারীকে বিধবা করেছে, সন্তানকে করেছে পিতৃহারা। বাংলাদেশ আর কত সংখ্যালঘুদের দীর্ঘশ্বাস বহন করবে?

সরকারকে একটি বিষয় স্বীকার করতে হবে যে রাজনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর তাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকার পরও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে পারেনি; সংখ্যালঘুদের অনেক এবং পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে হামলা হয়েছে, প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে, আক্রমণ করা হয়েছে বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও।

দেশে সরকারি দল আছে, বিরোধী দল আছে, প্রশাসন আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন বাহিনী আছে, গোয়েন্দা সংস্থা আছে, নাগরিক সমাজ আছে, বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার সচেতন মানুষ আছেন; এতসব থাকার পরও কেন আমরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারলাম না? কেন তাঁদের ঘরবাড়ি, মন্দির, মণ্ডপ ভাঙচুর হলো?

বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের মতো ক্ষমতাধর সরকার অতীতে আসেনি; ভবিষ্যতেও আসবে কি না সন্দেহ। তারপরও সংখ্যালঘুরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছেন না, তাঁদের ভাবতে দেওয়া হচ্ছে না। এটিকে নিছক সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে পার পাওয়া যাবে না। দায় এড়ানো যাবে না বিদেশি শক্তির চক্রান্ত হিসেবে জাহির করেও।

সরকারের দাবি, বিরোধী দল সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছে। যদি এই অভিযোগের পক্ষে তথ্যপ্রমাণ থাকে, কেন তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হচ্ছে না? কেন চট্টগ্রামে মন্দিরে হামলার মামলায় বিএনপির এমন তিন ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যাঁরা আগে থেকেই কারাগারে। তাহলে কি কারাগারে থেকেই তাঁরা মন্দিরে হামলা চালিয়েছেন? এখানে বিএনপি, আওয়ামী লীগ বিষয় নয়; যারাই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে বা হামলায় ইন্ধন দিয়েছে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কিন্তু গয়রহ মামলা দিলে আসল অপরাধীরা আড়ালে থেকে যাবে।

ফেসবুকে উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ ডজনখানেক নেতা-কর্মীদের সাময়িক বহিষ্কার করেছে। তাহলে সমস্যাটি কেবল বিরোধী দলের ভেতরে নয়, আওয়ামী লীগ বা এর সহযোগী সংগঠনের মধ্যেও আছে। এই সত্যটি স্বীকার করুন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন একজন প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যে ভাষায় মানুষকে খেপিয়ে তুলেছেন, কোনো বিরোধী দল কিংবা ধর্মীয় নেতারাও তা করেননি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী রংপুরে পীরগঞ্জের জেলেপাড়ার আক্রান্ত মানুষগুলোর চেহারা দেখে যে খেদের কথা বলেছেন, সেটাকে কেবল সরকারবিরোধী বক্তব্য বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তিনি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বন্ধ করতে না পারার জন্য সরকার ব্যর্থ হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন। সেই সঙ্গে এ কথাও বলেছেন, ‘আমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের মধ্যে মানবতাবোধ থাকলে এই মানুষগুলোকে রক্ষা করতে পারতাম।’ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, ভোটের সময় রাজনীতিকেরা সংখ্যালঘুদের বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেন; কিন্তু ভোটের পর তা ভুলে যান, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন না। অনেকে বলেন, বিএনপির কাছে সংখ্যালঘুদের চাওয়া–পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যেই দলের ওপর এখনো তাঁরা ভরসা করেন, সেই দলটিই বা সংখ্যালঘুদের জন্য কী করেছে? কতজন সংখ্যালঘু অর্পিত সম্পত্তি ফেরত পেয়েছেন?

এতক্ষণ যেসব ঘটনা বললাম, তার সবটাই হতাশা ও বেদনার কথা। এমনকি শাহবাগে প্রথম দিন যখন প্রতিবাদকারীদের মধ্যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের স্বল্প উপস্থিতি দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল। যাঁদের ওপর হামলা হয়েছে, তাঁদেরই যদি প্রতিবাদ করতে হয় এবং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় নির্বিকার থাকে, তাহলে আমরা নিজেদের কতটা দায়িত্বশীল নাগরিক বলে দাবি করতে পারি?

কিন্তু যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আতিকুর রহমানকে দেখি সহিংসতার বিরুদ্ধে একা চোখে কালো পর্দা ও বুকে ব্যানার ঝুলিয়ে ছয় ঘণ্টা প্রতীকী অবস্থান করেছেন; তখন আশান্বিত হই। আশান্বিত হই যখন দেখি অপরাজয়ে বাংলার সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পথনাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে সহিংসতার ভয়াবহতা তুলে ধরেন, তখন ভাবি এখনো মানুষের বিবেক জাগ্রত আছে; যখন দেখি শাহবাগে বাম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করে হামলাকারীদের প্রতি ধিক্কার জানান, তখনো মনে হয় সমাজ থেকে মানবতা নিঃশেষিত হয়ে যায়নি।

আমরা আশা হারাই না, যখন দেখি প্রতিবেশী মুসলমানেরা সারা রাত হিন্দুপাড়া পাহারা দিয়েছেন কিংবা পীরগঞ্জের আক্রান্ত মানুষগুলোর প্রতি সহায়তার হাত প্রসারিত করেছেন স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। আমরাও মনে করি, রাজনীতি যত কলুষিত হোক না কেন, রাজনীতিকেরা সমাজে যতই বিভাজন তৈরির চেষ্টা করুন না কেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত মনুষ্যত্বের জয় হবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম–সম্পাদক ও কবি