তবে কি সিসির কাছে হেরে গেলেন এরদোয়ান?

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি

মিসরের ইতিহাসে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে সিসির সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৃহৎ অর্থে তুরস্ক-সৌদি বলয় দ্বন্দ্ব শুরু। পরে সিরিয়া, লিবিয়া যুদ্ধ, কাতার অবরোধ, ইরান প্রীতি, ভূমধ্যসাগরের সীমানা সম্পর্কিত যুদ্ধাবস্থা আর সর্বশেষ সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সৌদি বলয়ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। দ্বিপক্ষীয় এই শীতল সম্পর্ক ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবরোধে রূপ নেয়। আরব দুনিয়া থেকে আঙ্কারা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সর্বশেষ জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড আঙ্কারাকে বেশ কিছু বিষয় হাতে–কলমে শিখিয়েছে। দুর্বৃত্তায়ন আর জাতিবাদী সন্ত্রাসের এই যুগে নৈতিকতা, সততা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থের প্রশ্নে রাষ্ট্রকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে নতুবা তলিয়ে যেতে হবে। তাই দেরিতে হলেও ‘আবেগী’ পররাষ্ট্রনীতি ত্যাগ করে বাস্তবমুখী পররাষ্ট্রনীতির পথ ধরেছেন এরদোয়ান। নতুন এই পররাষ্ট্রনীতির প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে আঙ্কারা-কায়রো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ।

নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে প্রকাশ, দীর্ঘ আট বছর পর মিসর ও তুরস্ক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। উভয় দেশের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ব্যক্তিগতভাবে এরদোয়ান এই খবর নিশ্চিত করেছেন। মিসরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুরসিকে ২০১৩ সালে উৎখাতের প্রতিবাদে আঙ্কারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে সর্বনিম্ন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিল। আজ এমন একসময়ে সম্পর্ক উন্নয়নের এই খবর এসেছে, আঙ্কারা যখন নানা ধরনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক অবরোধে জর্জরিত, আরবদের একটি বিশাল অংশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ করছে। নিঃসন্দেহে এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আঞ্চলিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।

প্রায় সব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই মিসর ও তুরস্কের এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীরণের বিষয়টিকে ভূমধ্যসাগরের সীমানা নির্ধারণ, আঞ্চলিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ কিংবা সৌদি-মিসর সম্পর্ক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। উপরে উল্লিখিত নিয়ামকগুলোকে বাদ দিয়ে বর্তমান মিসর-তুরস্ক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিকে একতরফা পঠনের চেষ্টা যে রকম অপূর্ণাঙ্গ, ঠিক একইভাবে শুধুই এই নিয়ামকগুলোর ওপর ভর করে নতুন এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে পঠনের চেষ্টা করলে আঞ্চলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বাদ পড়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে নজরে আনা জরুরি। তাই তুরস্কের ভূমধ্যসাগরের সীমানা নির্ধারণ ইস্যুকে মিসরের সঙ্গে মিশিয়ে পঠনে আমি আগ্রহী নই। কারণ, অত্যন্ত পরিষ্কার। ভূমধ্যসাগরের সীমানা নির্ধারণের প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সামরিক এবং রাজনৈতিক উপস্থিতি আঙ্কারা প্রমাণ করেছে। গত গ্রীষ্মে এমানুয়েল মাখোঁর ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ, পরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক এবং সামরিক অবরোধের হুমকিও আঙ্কারার অবস্থানকে বদলাতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। তাই চিন্তা করলেই দৃশ্যমান হয় যে এই সম্পর্ক উন্নয়নের কলকাঠি অন্য কিছু।

এরদোয়ানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এই আগ্রহে পরিষ্কার বিজয় হয়েছে পশ্চিমের পছন্দের স্বৈরাচার সিসির। ২০১৩ সালে মুরসিকে উৎখাতের পর থেকে কখনোই সিসির বৈধতা স্বীকার করেননি এরদোয়ান। বরং আন্তর্জাতিক নানা মজলিশে সিসিকে গণতন্ত্রের হত্যাকারী ও মিসরের হাজার হাজার মানুষের খুনি হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

প্রধানত তিনটি স্পষ্ট কারণে উভয় পক্ষই নতুন করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী।
প্রথমত, লিবিয়া। এক হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্তযুক্ত লিবিয়ায় মিসরের বিশাল স্বার্থ রয়েছে। লিবিয়ায় আকস্মিক শান্তির পতাকা উড়ছে। দীর্ঘ প্রায় এক বছর আলোচনার পর নতুন সম্মিলিত সরকার গঠন হয়েছে। নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় এই সরকার। পশ্চিমের চাপিয়ে দেওয়া ১০ বছরের যুদ্ধে লিবিয়ার প্রায় সব অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। নতুন অবকাঠামো নির্মাণ এবং লিবিয়া পুনর্গঠনে শিগগিরই বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করবে নতুন সরকার। বর্তমানের হিসাবে লিবিয়ার বার্ষিক প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। যুদ্ধ সমাপ্তি এবং পশ্চিমা অবরোধ উঠে গেলে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হবে লিবিয়ার। এই অর্থের একটি বিশাল অংশ আগত বছরগুলোতে লিবিয়া পুনর্গঠনের কাজে খরচ হবে। তাই লিবিয়া পুনর্গঠনের কাজ পেতে সিসি সরকার মরিয়া। করোনা মহামারিতে স্থবির মিসরের পর্যটন এবং শ্রম বাজারের জন্য এই পুনর্গঠনের অংশীদার হওয়া খুবই জরুরি।

কায়রো বেশ ভালোভাবেই অবগত যে লিবিয়ায় তুরস্কের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে ভালো করার সম্ভাবনা কম। সমঝোতার মধ্যেই রয়েছে স্বার্থ। তাই আগত সময়ে লিবিয়ার পুনর্গঠনে মিসরের একটি বিশাল ভূমিকার ঘোষণা এলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। একই সঙ্গে লিবিয়ায় ব্রাদারহুডের তৎপরতার বিষয়ে একটি সমঝোতায় আসতে চান সিসি।

দ্বিতীয়ত ফিলিস্তিন। ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর চুক্তি’তে এমবিএসের নেতৃত্বে সৌদি বলয়ের সমর্থন ফিলিস্তিনিদের শতবর্ষী আন্দোলনকে মচকে দিয়েছে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে যুদ্ধ তো নয়ই বরং আলোচনার টেবিলেও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যে আর নেই, মোহাম্মাদ বিন সালমানের [এমবিএস] কণ্ঠে তা বারবার প্রকাশ পেয়েছে। ফিলিস্তিনে প্রায় ১৫ বছর পর আগামী মে এবং জুনে যথাক্রমে স্থানীয় এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে।

সৌদি বলয় মোহাম্মাদ বিন দাহলানকে বিজয়ী করে ফিলিস্তিনিদের আন্দোলনকে একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে বেঁধে ফেলতে চায়। কিন্তু আঙ্কারা-দোহা ফিলিস্তিন প্রশ্নে ছাড় দিতে নারাজ। এই বলয় ১৯৬৭ সালের সীমানা ধরে দ্বিরাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য আলোচনা আর আন্দোলন জারি রাখতে চায়।। সৌদি বলয়ের এই ছকের বিরুদ্ধে হামাসকে সঙ্গে নিয়ে আঙ্কারা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। অন্যদিকে মিসর ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে প্রধান চালক। তাই এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেভাবে রাজনৈতিকভাবে আঙ্কারাকে সাহায্য করতে পারে, একইভাবে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের জন্য মানবিক সাহায্য প্রদানের জন্য দরজা খুলে দেবে।

তৃতীয়ত, তুরস্কবিরোধী জোটকে দুর্বল করা। ওবামা আমলের ক্ষত কাটিয়ে সিরিয়া, লিবিয়া ও নাগারনো কারাবাখে প্রকাশ্যে যুদ্ধে জড়িয়েছে আঙ্কারা। ভূমধ্যসাগরে স্বার্থ রক্ষায় যুদ্ধের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে এমবিএসকে ক্রমাগত অভিযুক্ত করেছে আঙ্কারা।

আঙ্কারার এই ‘উগ্র’ মনোভাবের দরুন প্রতিবেশী দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি বলয় চিন্তিত। এই চিন্তা থেকেই সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যে এবং ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক বিরুদ্ধ কয়েকটি ঘোষিত এবং অঘোষিত আরব জোট গঠন হয়েছে। ফরাসি ও গ্রিকরাও এই জোটের অংশীদার। সৌদি বলয়ের পাশাপাশি বাইডেন প্রশাসনও আঙ্কারার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। আগত এই কঠিন সময় চিন্তা করেই আঙ্কারা প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সঙ্গে মীমাংসায় যেতে চায়। তাই যতটা সম্ভব আঞ্চলিক রাজনীতির সমস্যা সমাধান করে এরদোয়ান আলোচনার টেবিলে সিরিয়া, লিবিয়া এবং এস-৪০০ বিষয়ে বাইডেনের সঙ্গে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে চান।

এরদোয়ানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এই আগ্রহে পরিষ্কার বিজয় হয়েছে পশ্চিমের পছন্দের স্বৈরাচার সিসির। ২০১৩ সালে মুরসিকে উৎখাতের পর থেকে কখনোই সিসির বৈধতা স্বীকার করেননি এরদোয়ান। বরং আন্তর্জাতিক নানা মজলিশে সিসিকে গণতন্ত্রের হত্যাকারী ও মিসরের হাজার হাজার মানুষের খুনি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এরদোয়ানের এই অবস্থান ছিল মুরসিপন্থীদের প্রধান মনোবল। কিছুটা সাহস জুগিয়েছিল মুরসিবিরোধী গণতন্ত্রপন্থীদেরও। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে ব্যবহার করে যেভাবে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ এবং অর্থনৈতিক শক্তি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, ঠিক একইভাবে একেপি পার্টি ভেঙে রাজনৈতিকভাবে তুরস্ককে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির দরুন এরদোয়ান এই নতি স্বীকার করেছেন। স্পষ্ট বিজয় হয়েছে সিসির।

আল আহরাম থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব সৌদি বলয়পন্থী গণমাধ্যম এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নকে স্পষ্ট এরদোয়ানের পরাজয় হিসেবে অভিহিত করেছে। মিসরের সেনাবাহিনী পরিচালিত আল ওয়াতান সংবাদমাধ্যম লিখেছে, এরদোয়ানের এই পদক্ষেপের দরুন ষড়যন্ত্রকারীরা পরাজিত হয়েছে। নিঃশেষ হয়েছে ব্রাদারহুড। আশা রাখছি মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে আগ্রহী পাঠক বুঝতে সক্ষম হয়েছেন আদতে এই ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের পরাজয় ঘটেছে। যাঁরা সিসিকে বার্লিনে, লন্ডনে এবং ওয়াশিংটনে লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছেন, তাঁরাই গণতন্ত্রকে হারিয়ে দিয়েছেন। ওবামা, ম্যার্কেল থেকে শুরু করে এই তালিকায় আছেন জো বাইডেনও। মুরসি হত্যার বিচার হয়নি। সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার অভিযোগ থেকেও এমবিএসকে রেহাই দিয়েছে মার্কিনরা। মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমের এই ক্রমাগত গণতন্ত্র হত্যার লাগাম টেনে ধরা গণতন্ত্রপন্থীদের জন্য ক্রমেই দুরূহ হয়ে উঠছে।

রাহুল আনজুম মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক