তাঁর কবিতায় বাংলাদেশের ইতিহাস

শামসুর রাহমান
শামসুর রাহমান

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবেমাত্র জন্ম হয়েছে। এর মাস দেড়েকের মধ্যেই, ১৯৭২ সালের ২৯ জানুয়ারি, কলকাতার পার্ল রোড থেকে যুদ্ধধ্বস্ত বাংলাদেশের এক কবিকে চিঠি লিখলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব। তাতে যুদ্ধের তাণ্ডব নিয়ে লেখা তাঁর একটি কবিতার অকুণ্ঠ প্রশংসা। তিনি লিখলেন, ‘“এখানে দরজা ছিলো” অসাধারণ সুন্দর কবিতা। বহুদিন এমন মর্মগ্রাহী কবিতা পড়িনি। খাঁটি কবিতা, অথচ বাণীময় অর্থঘন...। সেটি এবং “স্যামসন” দেশ পত্রিকায় প্রকাশার্থে পাঠিয়েছি, দু’এক সপ্তাহের মধ্যে ছাপা হবে আশা করি। আপনার বই এতো তাড়াতাড়ি প্রকাশ হয়ে যাওয়াতে আমরাও দুঃখিত হয়েছি, কারণ কোনো সন্দেহ নেই যে, পরে পাঠানো কবিতাগুলি অন্তর্ভুক্ত হলে সংগ্রহটি আরো অনেক সমৃদ্ধ হতো।’

কলকাতার সুধীমহলে আবু সয়ীদ আইয়ুবের অবস্থান তখন মধ্যগগনে। পরিচয় পত্রিকায় প্রথমবার বাংলায় লিখেই অবাঙালি এই পণ্ডিত খোদ রবীন্দ্রনাথকে চমকে দিয়েছিলেন। সেটা ১৯৩৪ সালের কথা। এর মধ্যে তাঁর আরও ক্ষুরধার লেখা বেরিয়ে গেছে। এই চিঠি লেখার তিন বছর আগে বেরিয়েছে রবীন্দ্রনাথের পক্ষ নিয়ে আধুনিক কবিদের সঙ্গে তাঁর ঝাঁজালো তর্কের বই আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ। যে কবিকে তিনি লিখছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাঁকে চিনেছেন মজলুম আদিব নামে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় কবি দেশে অন্তরীণ। কিন্তু অন্তরীণ এই কবির কবিতা পেয়ে গিয়েছিল এক মুক্তির পথ। তিনি লিখছিলেন, আর তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা কায়দায় সেসব লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অবরুদ্ধ দেশের সীমান্তের ওপারে।

যুদ্ধের ঘোরগ্রস্ত দিনে সেই কবিতাগুলোই পৌঁছাচ্ছিল আবু সয়ীদ আইয়ুবের হাতে, নানা হাত ঘুরে। আর তিনি করছিলেন পত্রপত্রিকায় তার ছাপানোর ব্যবস্থা। পাছে দেশের ভেতরে কবির বিপদ হয়, আইয়ুব তাই একটি ছদ্মনাম দিয়েছিলেন কবির—মজলুম আদিব। মানে নিপীড়িত লেখক। এই ছদ্মনামের আড়ালে যাঁর হাত দিয়ে বাঙালির মুক্তির আবেগ ও স্বপ্ন ভাষা পাচ্ছিল, তিনি শামসুর রাহমান। তাঁর সেসব কবিতার শেষ দুটি গুচ্ছ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রায় পরপর—মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে, ১৮ ও ২৫ ডিসেম্বর। আইয়ুব চিঠিতে লিখছেন, ‘আপনার চারটি কবিতা পড়ে অনেক পাঠক আপনার আশু প্রকাশিতব্য কবিতাগুচ্ছের জন্য বেশ উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন, প্রকাশক তাই বইখানা এত তাড়াতাড়ি ছাপিয়ে ফেলেন।’ বইটি প্রকাশিত হয় পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে, বন্দী শিবির থেকে নামে, যে বইয়ে ধরা আছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের হৃৎস্পন্দন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় শামসুর রাহমান যে দেশ ছেড়ে যাননি, তা নিয়ে জল্পনা কম হয়নি। জল্পনা কখনো কখনো কুৎসার রূপও নিয়েছে। যুদ্ধদিনে পরিবারের পাশে থাকা আর নিরাপদে ভারত-প্রস্থান—এই বিপরীত দুই টানে শামসুর রাহমান প্রথমটির পক্ষ নিয়েছিলেন। হুবহু এ রকম আরেকটি ঘটনার কথা বলেছিলেন ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে। দ্বিতীয় মহাসমরের সময় নাৎসি জার্মানি ফ্রান্স দখলে নিয়ে নেওয়ার জন্য মুখেতীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। সে সময় দ্বিধাগ্রস্ত এক তরুণ পরামর্শ চাইতে এল সার্ত্রের কাছে। দেশের জন্য সেই তরুণ তার প্রাণ উৎসর্গ করতে চায়। কিন্তু সে ছাড়া তার বৃদ্ধা মায়ের যে কেউ নেই। সে কি তার অবলম্বনহীন মায়ের কাছেই থাকবে, নাকি দেশের জন্য প্রাণ বিলিয়ে দিতে চলে যাবে? সার্ত্রে বলেছিলেন, এই দুই বিকল্পের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠতর, সে প্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছে নেই। এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এখনো হয়তো তর্ক চলবে। কিন্তু শামসুর রাহমান সেদিন যেসব কবিতা লিখেছিলেন, সেগুলোতে শুধু তাঁর নয়, বাঙালির সে সময়কার আবেগও স্থায়ী হয়ে রইল।

১৯৫২ সালের যে ভাষা আন্দোলনে পূর্ব বাংলার বাঙালি নিজের পথ খুঁজতে শুরু করল, কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের সূচনাও সেখান থেকেই। এরপর থেকে যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের শিক্ষিত শ্রেণি আমাদের ইতিহাসের মূলধারা রচনা করেছেন, তার প্রতি সক্রিয়ভাবে সাড়া দিয়েছে তাঁর কবিতা। হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’তে কবিতা নিয়েছিলেন মাত্র একটি, শামসুর রাহমানের ‘আর যেন না দেখি’। কবিতাটি লেখা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের বেশ আগে। হাসান কবিতাটি নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল একুশের ঘটনা ঘটার আগেই তাঁর উৎকণ্ঠা, গৌরব আর পূর্বসংকেত এ কবিতায় ধরা পড়েছিল।

তবু শামসুর রাহমান তখনো ইতিহাসের রাজপথে এসে দাঁড়াননি। তাঁর একাকিত্ব ভেঙে দেয় ১৯৬০-এর তুমুল দশক। সে সময়ের টগবগে রাজনৈতিক পটভূমিকায় তাঁর আমূল বদল ঘটে। মুক্তিযুদ্ধপূর্বের কম্পমান আবেগ এক উদ্‌গিরণে বেরিয়ে আসে তাঁর ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায়। শামসুর রাহমানের কবিতা এরপর থেকে এক নতুন ইতিহাস।

বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতা। এমন একটি প্রবাদ আছে যে আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন শহরটি কখনো লুপ্ত হয়ে গেলে জেমস জয়েসের ডাবলিনার্স বইটি থেকে আবার সেটি গড়ে তোলা সম্ভব। এই একই কথা অন্যভাবে শামসুর রাহমানের কবিতার বেলায়ও খাটে। তাঁর কবিতা থেকে গড়ে তোলা সম্ভব আমাদের জাতীয়তাবাদী ও উদার গণতান্ত্রিক ইতিহাসের এক যথাযথ পরম্পরা।

স্বাধীনতার পরও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সোচ্চার আন্দোলনে শামসুর রাহমান তাঁর কবিতা সমর্পণ করেছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এ দেশ সমরতন্ত্রের বুটে চাপা পড়লে তিনি লিখেছিলেন ‘ইলেকট্রার গান’; পেট্রোডলারের আশকারায় সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে লিখেছেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের গুলিতে নূর হোসেনের মৃত্যু হলে লিখলেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। তাঁর কবিতা লিফলেট হয়ে মানুষের হাতে হাতে ফিরেছে; বহু পঙ্‌ক্তি রাতারাতি পেয়েছে প্রবচনের লোকপ্রিয়তা; উঠে এসেছে পোস্টারে, প্ল্যাকার্ডে, দেয়াললিখনে।

কিন্তু শুধু কবিতায় তো নয়, মানুষ হিসেবেও লিপ্ত হতে হয়েছিল শামসুর রাহমানকে। ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বাকশালের একদলীয় স্বেচ্ছাচার প্রতিষ্ঠার সেই ঘোর নিদানকালে এক গরীয়ান দৃঢ়তায় যাঁরা এর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি সেই মুষ্টিমেয়র একজন। এরশাদ সরকারের সময় তাঁর লাঞ্ছনা চূড়ায় পৌঁছেছিল। শামসুর রাহমানের একের পর এক ঝাঁজালো কবিতায় ক্রুদ্ধ এই কবিযশোপ্রার্থী সমরশাসক সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রিন্টার্স লাইন থেকে প্রধান সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম মুছে দেন। দাপটের পাশাপাশি প্রলোভনও তাঁকে কম দেখানো হয়নি। কবির মুখেই শুনেছি, তাঁকে রাষ্ট্রদূত করে প্যারিসে পাঠানোর লোভনীয় প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। তিনি ভ্রুক্ষেপ করেননি। এরশাদের স্বৈরাচারের প্রতিবাদে চাকরি ছেড়ে নেমে এসেছিলেন জনতার মিছিলে।

কবি হিসেবে শামসুর রাহমানের ঐতিহাসিকতা তবু এখানেই নয়। ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায় তরুণ এই কবি তাঁর ‘রূপালি স্নান’ কবিতাটি ছাপতে দিয়েছিলেন সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায়। সাহিত্য সম্পাদক আবদুল গনি হাজারী ডেকে পাঠালেন তাঁকে। পত্রিকা অফিসে গিয়ে শামসুর রাহমান দেখতে পেলেন, কবিতাটির কিছু শব্দ লাল রেখায় দাগানো। শব্দগুলো বদলে দিলেই কেবল কবিতাটি ছাপা হতে পারে। অসম্মতি জানিয়ে কবিতাটি নিয়ে চলে এলেন কবি।

ছোট এই ঘটনার মধ্যে সেদিন খচিত হয়ে থাকল বাংলা কবিতার নতুন একটি যুগেরও সূচনা। শামসুর রাহমানের সেই প্রত্যাখ্যান কেবল একজন ব্যক্তির প্রতি ছিল না; ছিল বাংলা কবিতার এক ধরতাই রীতির প্রতি, রুদ্ধ এক মানসিকতার প্রতি, একটি পুরোনো যুগের প্রতি।

১৯৩০-এর দশকে আধুনিকতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা কবিতা ভাগ হয়ে পড়েছিল স্পষ্ট দুটি ধারায়। বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে একদিকে রইল, যাকে বলা যেতে পারে, শুদ্ধতাবাদী নান্দনিক ধারা। এই বৃত্তের কবিতায় রইল ব্যক্তির আবেগ। সবাইকে জড়িয়ে মানুষের যে বৃহত্তর জীবন, তার রেশ সেখানে রইল না। অন্যদিকে রইল প্রগতিশীল ধারা। জনতার উচ্চকণ্ঠের কাছে সেখানে তুচ্ছ হয়ে গেল মানুষের একান্ত আবেগ। কবিতার এই কৃত্রিম বর্ণাশ্রম শামসুর রাহমান বিনা আয়াসে ভেঙে দিলেন। তিনি এমন এক অনায়াস নমনীয় ভাষা তৈরি করলেন, যার মধ্যে দুটি ধারাই পোষ মেনে পাশাপাশি ঠাঁই করে নিতে পারল। একই কবির পক্ষে দুই রকম কবিতা লেখার বানিয়ে তোলা ব্যবধানটিও আর রইল না। সেদিনের সেই ছোট্ট ঢাকা শহরের বুকে শিক্ষিত বাঙালিরমধ্যে অভিষেক ঘটল নতুন বাংলা কবিতার।

অনায়াস এই সহজ ভাষা তাঁর কবিতা অবাধও করে দিল সবার জন্য। শামসুর রাহমানকে নিয়ে অন্তত আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতার অভিযোগ কখনো ওঠেনি। তাঁর কবিতায় ঢুকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আবিষ্কার করল, এ কবিতা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতার পরিধির বাইরের জিনিস নয়। শামসুর রাহমান শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে কবিতার এক পাঠকশ্রেণি জন্ম দিলেন। এর পরের ইতিহাস তাঁর বিজয় অভিযানের। তাঁর কবিতার ভাষা এরপর দশকের পর দশক বাংলাদেশের কবিতায় নিশান উড়িয়ে রাজত্ব করল। সেটিই হয়ে উঠল এখানকার কবিতার প্রায় অনন্য এক ভাষা। শামসুর রাহমান দেশের প্রধান কবি হিসেবে বৃত হলেন।

তাঁর কবিতার সেই ছকে পা দিয়ে কোন কবি আনমনে চোরাবালিতে হড়কে পড়েননি? নবীন কোন কবি জীবনের প্রথম কবিতা লিখতে গিয়ে হাত মকশো করেননি তাঁর ‘স্বাধীনতা তুমি’র আদলের ওপর? এভাবেই শামসুর রাহমান ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন কবিতারই এক প্রতিমূর্তি।

আর কোন কবির জীবনে এতটা ঘটেছে, এই বাংলাদেশে?

সাজ্জাদ শরিফ: কবি, সাংবাদিক।