তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়

জামিলুর রেজা চৌধুরী

জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হয় বুয়েটে স্যারের ক্লাসে। স্যার আমাদের পড়াতেন স্ট্রাকচার, ট্রাস। স্যার এমনভাবে পড়াতেন, যেন তিনি একটা মানবিক কম্পিউটার। প্রথম দশ মিনিটে বলতেন, ‘গত ক্লাসে আমরা শিখেছি;’ তার পরের কুড়ি মিনিটে নতুন পড়া পড়াতেন। শেষ দশ মিনিটে যা পড়িয়েছেন, তা আবার বলতেন এবং ছাত্রদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতেন। ফলে ক্লাসেই স্যারের শেখানো পড়া আমরা শিখে ফেলতে পারতাম। পরীক্ষায় তিনি যা পড়িয়েছেন, তা-ই প্রশ্নে দিতেন।

তারপর স্যারের সঙ্গে প্রায়ই মিটিং করতে হতো ইউকসুর বার্ষিকী সম্পাদক হিসেবে। স্যারকে চেয়ারম্যান করে এডিটরিয়াল বোর্ড করা হলো। সেই বোর্ডের মিটিংয়ে আমি উপস্থিত থাকতাম। আমি পাস করে বেরিয়ে আসার পরেও মিটিং হতো। আমি তাতেও থাকতাম। আমার সময়ে ওই জার্নাল বেরিয়েছিল।

স্যার তখন আমার খোঁজ নিতেন: ‘তুমি কী করছ?’

‘পত্রিকায় কাজ করছি।’

‘ভেরি গুড। করো। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা সব করতে পারে। দেখো, আবুল হায়াত কত সুন্দর অভিনয় করছেন।’

তারপর স্যার পত্রিকা অফিসে ফোন করতেন। ‘আনিসুল হক, কেমন আছ? তোমার লেখা পড়ি। তুমি এই লাইনে থেকে যাও।’

স্যার প্রতিবছর বইমেলায় যেতেন। আর আমি দৌড়ে গিয়ে স্যারকে আমার নতুন বই দিয়ে আসতাম। স্যার পড়তেন আর আমাকে ফোন করতেন।

একবার বুয়েটে আর্কিটেকচারের ভর্তি পরীক্ষা বদলানোর চেষ্টা হলো। আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্ট ধর্মঘট করল। ব্যাপক গোলযোগ। আমি স্যারের কাছে গেলাম। ‘স্যার, ব্যাপার কী?’

স্যার বললেন, ‘তুমি কি রশোমন দেখেছ?

আমি বললাম, ‘আকিরা কুরোসাওয়ার ছবি? জি, দেখেছি।’

‘এই সিনেমায় কী হয়? একটা ঘটনা ঘটে। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সেটার বর্ণনা দেয়। কিন্তু প্রত্যেকের বিবরণ আলাদা। তাই না?’

‘জি স্যার।’

‘এখন আমি যদি এই ঘটনার বর্ণনা দিই, সেটা এক রকম হবে। আর্কিটেকচারের একজন টিচার যদি দেন, সেটা আরেক রকম হবে। তুমি সবারটা শোনো। তাহলে পুরা ছবিটা পাবে।’

স্যার প্রচুর বই পড়তেন, প্রচুর সিনেমা দেখতেন, প্রচুর গান শুনতেন এবং প্রচুর মানুষের সঙ্গে মিশতেন। এ বিষয়ে তিনি এফ আর খানের দর্শন মানতেন। প্রকৌশলবিদকে মানবিক হতে হবে। মানুষের কাছে যেতে হবে। ‌এফ আর খান বলেছিলেন, ‘একজন প্রযুক্তিবিদের আপন টেকনোলজিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হবে, আর জীবন হলো শিল্প, সংগীত, নাটক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জীবন হলো মানুষ।’

একদিন প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার লেখা একটা প্রহসনধর্মী নাটিকা মঞ্চস্থ হলো। স্যার বললেন, ‘আনিস, তোমার নাটকটার মতো একটা বই আছে, একটা নাটক আছে, আর একটা সিনেমা আছে।’ স্যার সব কটার নাম বলেছিলেন। এখন আমার মনে নেই।

আমার সাক্ষাৎকার পত্রপত্রিকায় পড়তেন। একদিন বললেন, ‘আনিস, তুমি বলেছ, তোমার জীবনের রিগ্রেট হলো তুমি ইংরেজি জানো না। আরেকটা জীবন পেলে তুমি ইংরেজি শিখবে। আরেকটা জীবন পেতে হবে কেন। এখনই আজ থেকে শিখতে শুরু করো।’ আরেক দিন বললেন, আনিস, ‘তুমি মা বইয়ের প্রামাণ্যচিত্রটাতে বলেছ, ‌প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেল। এটা তো ভুল বলা হলো। প্যান্ডোরার বাক্স তো ভালো জিনিস না। অমঙ্গলের জিনিস বের হয় ওটা থেকে।

স্যারের ছেলে বা মেয়ের বিয়ে। আমি তখন থাকি ধানমন্ডি ৪ নম্বরে। সেদিন ছিল লিফট নষ্ট। তিনি হেঁটে চতুর্থ তলায় উঠলেন। দরজায় বেল বাজালেন। আমি লজ্জায় মারা যাই। বিয়ের কার্ড দিয়ে গেলেন।

স্যারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম প্রথম আলোয়, তাঁর মৃত্যুর ১০ দিন আগে। করোনাকালে সরকারের কী করণীয়, নাগরিকদের কী করণীয়। স্যার বলেছিলেন, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিম্নবিত্ত মানুষদের টাকা পাঠাতে হবে। সেটা স্যারের লেখা হিসেবে পরের দিন প্রথম আলোয় ছাপা হলো। তিনি আমাকে এসএমএস পাঠালেন, ‘আনিস, আমি কী এমন বললাম, তুমি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে লিখেছ। ধন্যবাদ।’

সেটাই ছিল আমার সঙ্গে স্যারের শেষ কথা।

স্যার একটা আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর

ক মাস আগে আমি তাঁর বড় ইন্টারভিউ নিয়েছি, দুই দিন ধরে, জাতীয় জাদুঘরের জন্য। তাতে তাঁর শৈশব, বেড়ে ওঠা, ছাত্রজীবন, গবেষণা, দেশের আইটি সেক্টর, বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু, বুয়েটের কম্পিউটার ল্যাব—সব বিষয় উঠে এসেছে।

স্যারের বুদ্ধিমত্তা ছিল কম্পিউটারের মতো। কিন্তু স্যারের তার চেয়ে বড় ছিল হৃদয়। স্যারের কোন ছাত্র পৃথিবীর কোনখানে আছে, তা ছিল তাঁর মুখস্থ।

স্যার খেলাধুলা পছন্দ করতেন। ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। ফিল্ম ক্লাব করতেন। আর প্রথম আলোর সঙ্গে করতেন গণিত অলিম্পিয়াড। সুডোকু তাঁর পছন্দ ছিল। প্রায়ই প্রথম আলোয় ফোন করে সুডোকুর ভুল ধরিয়ে দিতেন।

স্যার অনেক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান বা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড। পরিবেশ আন্দোলন। তিনি বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশেষজ্ঞ-পরামর্শক ছিলেন। দেশের প্রথম কম্পিউটার-প্রবর্তকদের তিনি একজন। আজকে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা দেখছি, তার শুরুর সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ছিলেন বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের প্রধান, যদিও তিনি নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ছিলেন গণিত অলিম্পিয়াডের সভাপতি। কত যে সময় দিতেন আমাদের। ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। বুয়েট তাঁর নামে সিভিল বিল্ডিংয়ের নামকরণ করেছে জেনে খুবই আনন্দিত হয়েছি।

তিনি ছিলেন মানবিক প্রকৌশলী। যিনি জানতেন, শিল্প, সাহিত্য, নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, ফিল্ম এবং মানুষ নিয়েই একজন প্রকৌশলী। আর তিনি ছিলেন অস্বাভাবিক মেধাবী একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। বিদেশে এফ আর খানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ ফেলে তিনি দেশে এসেছিলেন।

তাঁর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তাঁকে মনে পড়লে তাঁর হাসিমাখা মুখটাই মনে পড়ে।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক