সরকারি কর্মকর্তা: তাঁরা আক্রান্ত, জনগণের নিরাপত্তা কোথায়

হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হত্যাচেষ্টার ঘটনাটি স্রেফ একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা যায় না। দেশে হামেশাই বহু বাড়িতে ও অফিসে চুরি হয়ে থাকে। আগে মানুষের ঘরদোর কাঁচা ছিল বলে সিঁধ কেটে চুরি হতো। এখন সব পাকা দালানকোঠা। সিঁধ কাটার উপায় নেই। তাই রাতবিরাতে দরজা-জানালা ভেঙে চোর ঢোকে। ইউএনওর বাসভবনে সে রকম একটি ‘চুরি’ হয়েছে। তবে এমন আত্মভোলা চোর যে মালপত্র না নিয়ে গৃহকর্ত্রী ও তাঁর বৃদ্ধ বাবাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে জখম করেছে। যে আঘাত তিনি পেয়েছেন, মৃত্যু ছিল অবধারিত। আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে গেছেন। আজকাল চোর হাতুড়ি নিয়ে চুরি করতে যায়।

এই ঘটনায় ‘মূল সন্দেহভাজন’সহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাদেশে কোনো বড়সড় অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলেই চটজলদি যখন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন মানুষের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে জজ মিয়ার ছবি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অমর সৃষ্টি জজ মিয়া। তবে সঠিক তদন্ত হলে অ-জজ মিয়াদের খুঁজে বের করাও কঠিন নয়।

শনিবার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এটি কোনো চুরির ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ডের অভিপ্রায় নিয়ে ইউএনওকে আক্রমণ করা হয়েছে। কারণ, যখন ইউএনও এবং তাঁর বাবাকে আঘাত করা হয়, তখন দুর্বৃত্তরা কোনো সম্পদ চুরি করেনি বা বাসা থেকে কোনো জিনিস খোয়াও যায়নি। এমনকি তাঁর বিছানার ওপর পড়ে থাকা মোবাইলটিও নেয়নি। এটি একটি পরিকল্পিত আক্রমণের ঘটনা। এ ঘটনার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত থাকতে পারে। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা কঠিন।

সব পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা কারণে একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তা আমরা জানি। অবৈধ দখলকারীদের যখন তাঁরা উচ্ছেদ করেন, তখন তাঁদের শত্রু সৃষ্টি হয়। অবৈধ বালুমহালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তাঁদের শত্রু বেড়ে যায়। মহাপ্রকল্প নির্মীয়মাণ পদ্মা সেতুর নিচ থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বাধা দেওয়ার কর্তৃত্ব ইউএনওর। তা দিলেই হন বিরাগভাজন। সে বিরাগ শুধু মনে মনে নয়, তার প্রকাশ্য রূপ খুবই অশোভন। সব কর্মকর্তারই ব্যক্তিগত মান–মর্যাদা রয়েছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অপমানিত হতে কার ভালো লাগে! আমাকে অনেক কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক সময় বিষ খেয়েও বিষ হজম করতে হয়।

বর্তমান করোনা মহামারির সময় মাঠপর্যায়ের অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন এবং করে যাচ্ছেন। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা ও পুলিশ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ ও তাঁদের পরিবারের সদস্য মারা গেছেন শতাধিক।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের যে কাজ আমি শুরু থেকেই প্রশংসা করছি, তা হলো নারীর ক্ষমতায়ন। উপজেলা ও জেলা পর্যায় থেকে মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সচিব পদমর্যাদার বহু পদে তিনি নিয়োগ দিয়েছেন নারী কর্মকর্তাদের। বর্তমানে ৭ জেলার ডিসি নারী, এডিসি ৪০ জন নারী, মহিলা ইউএনও এখন ১৩৭, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ১৪৪ জন নারী। নতুন আরও ২৯ জন হয়েছেন। নারী কর্মকর্তারা তাঁদের যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন।

তবে রাষ্ট্রের কোনো কিছুই সামগ্রিক অবস্থার বাইরে নয়। সুশাসনের ঘাটতি থাকলে সমাজে ও রাষ্ট্রযন্ত্রে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। সমাজ নষ্ট হয়ে যায়। একশ্রেণির মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে মারাত্মক রকম। কয়েক বছর আগে এক ইউএনও আমাকে ফোনে জানান, তিনি সালোয়ার-কামিজ পরে এক সুপারমার্কেটে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন। কয়েকজন বখাটে তাঁকে উত্ত্যক্ত করে। তিনি বলেন, দয়া করে এসব নিয়ে লিখুন। তাঁকে বলেছি লিখে লাভ নেই। যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সারবে তা নকল, কেরানীগঞ্জের কারখানায় তৈরি।

বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ উধাও হয়ে গেছে। প্রত্যেকেই তাঁর নিজ নিজ পদে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যেকেরই উপযুক্ত মর্যাদা প্রাপ্য। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ প্রশাসনের জন্য বড় বাধা। উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে ইউএনওর এবং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে ডিসির অনেক ক্ষেত্রেই মতবিরোধ প্রকট। পরিবেশ, নদী রক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে উভয় পক্ষের বিরোধের স্বরূপ দেখতে পেয়েছি।

সরকারি দলের নেতা ও ক্যাডারদের দলপতিদের দৌরাত্ম্য এখন সীমা অতিক্রম করেছে। শুধু তাঁরা নন, অনেক সময় তাঁদের মা-বাবা ও শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাইবোন, শালা-শালির অনৈতিক আবদার পূরণ না করার পরিণাম হয় খুবই অশুভ। ক্ষেত্রবিশেষে অসময়ে অপ্রত্যাশিত বদলির আদেশ।

উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে যাঁরা প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক দায়িত্ব পান, তাঁরা রাষ্ট্রের সম্পদ। ব্রিটিশ আমলে মাথার ওপরে ঔপনিবেশিক সরকার থাকলেও কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতেন। সেই অধিকার ও সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা তার অপব্যবহার করতেন না। সে জন্য তাঁদের দাপট ছিল খুব বেশি। পাকিস্তান আমলে রাজনীতিকদের চেয়ে আমলারা বেশি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা মহকুমা প্রশাসক ও ডেপুটি কমিশনারের অফিসে গিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারতেন না। এখন ইউএনও ও ডিসির কার্যালয়ের নিচে ১০-১৫টি মোটরসাইকেল সারাক্ষণ থাকেই। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।

শুরু থেকেই বাংলাদেশের সব নির্বাচনে সরকারি দল প্রশাসন ও পুলিশের প্রত্যক্ষ সমর্থন পেয়ে ধন্য। সমর্থন তারা শখ করে দেয় না, দিতে বাধ্য হয়। প্রত্যেক নাগরিকেরই দলীয় রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে, বিশেষ দলের প্রতি থাকতে পারে তাঁর সমর্থন। কিন্তু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের সময় নিরপেক্ষতাই কাম্য। সেই নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি বিপদে পড়তে হয়, তা সামাল দেওয়া প্রায় কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

ঘোড়াঘাটের ইউএনওর ওপর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে সরকার সব ইউএনওর নিরাপত্তা জোরদার করেছে। বর্তমান বাস্তবতায় এর নিশ্চয়ই প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সশস্ত্র আনসার দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়া সমস্যার সমাধান নয়। কেন তাঁরা নিরাপত্তাহীন, তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং তা দূর করতে হবে। একদিকে সশস্ত্র আনসার, অন্যদিকে হাতুড়ি ও হেলমেট বাহিনী। সমস্যা থেকেই যাবে।

বর্তমানে রাজনীতিতে যে শূন্যতা, তার জন্য প্রশাসনের কর্মকর্তারা দায়ী নন। তাঁরা নাগরিকদের নিরাপত্তা দেন। তাঁদের নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত হয়, জনগণের নিরাপত্তা বলতে আর কিছু থাকে না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক