তাজ্জব হওয়ার আর বাকি কী আছে?

.
.

হঠাৎ করে নজর পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ওপর। ভাবটা এমন, যেন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা জাতীয়করণ করা স্কুল-কলেজে জঙ্গিবাদের কোনো ইতিহাস নেই, ঝুঁকিও নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালক-শিক্ষকেরা ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যের আশঙ্কায় বিচলিত। তাঁদের সামনে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, রংপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টান্তগুলো ভাসে। কথিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে হবেন, তা থেকে শুরু করে সব ধরনের টেন্ডার, ভর্তিসহ অনেক কিছুই নির্ভরশীল সরকারি দল ও ছাত্র সংগঠনের মর্জির ওপর। তবে মাদ্রাসাগুলোর পরিচালকদের তেমন কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কেননা, তাঁরা জানেন সেখানে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক জাল বিস্তারে পা ফেলার সম্ভাবনা নেই।

রাস্তাঘাটে নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর চেষ্টা দৃশ্যমান হলেও তাতে যাতে জনভোগান্তি না হয় বা যতটা সম্ভব কম হয়, সেটা নিশ্চিত করার কোনো চেষ্টা ছিল বলে মনে হয় না। বাড়তি নিরাপত্তা চাহিদার কারণে ডাক পড়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং আনসারদেরও। কিন্তু একটি বাহিনী যখন নিখোঁজ মানুষজনের খোঁজখবর করে সন্দেহভাজনদের তালিকা বানানোর কাজ করছে, তখন আরেকটি ইউনিট অসম্পূর্ণ এবং যাচাই-বাছাই ছাড়াই এ ধরনের তালিকা প্রকাশ করে দিচ্ছে। চরাঞ্চলে তল্লাশি অভিযানের ফলাফল দেখে সন্দেহ জাগে যে কোনো ধরনের গোয়েন্দা তথ্য ছাড়াই এ ধরনের বড় অভিযান চালানো হলো কি না। সমন্বয়হীন ও এলোমেলো কৌশল অনুসরণের মানে দাঁড়াবে সম্পদের অপচয়। ফলে প্রয়োজনের সময় অসতর্কতা দেখা দিলে তার পরিণতি হবে দুর্ভাগ্যজনক।

দেশে জঙ্গিদের নজিরবিহীন হুমকি সৃষ্টির পটভূমিতে রাজনৈতিক মতপার্থক্য সরিয়ে রেখে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটি অভিন্ন অবস্থান গ্রহণের জন্য নানা মহলের আহ্বান সরকার বেশ দ্রুততার সঙ্গেই নাকচ করে দিয়েছে। অথচ তাজ্জবের বিষয় হলো এই যে বিষয়টি নিয়ে বিদেশের মাটিতে আলোচনার আমন্ত্রণ কেউ প্রত্যাখ্যান করলেন না। প্রধানমন্ত্রীর দুজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা, একজন মন্ত্রী ও দুজন প্রতিমন্ত্রী লন্ডন ঘুরে গেলেন সরকারি খরচে (দলীয় বা ব্যক্তিগত অর্থে হলে আনন্দিত হব)। বিএনপিও বা কম যায় কেন? তাদেরও মহাসচিবসহ জনা চারেক নেতার লন্ডন সফর সম্ভব হলো। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাংলাদেশবিষয়ক সর্বদলীয় কমিটির কয়েকজন সদস্য তাঁদের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রতিবছরই দুবার করে এ ধরনের বাংলাদেশ সেমিনার করে থাকেন। তবে এবার এই সেমিনারের গুরুত্ব ছিল একটু আলাদা। এবার যুক্তিসংগত কারণেই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল জঙ্গিবাদের হুমকি। সেমিনারের উদ্যোক্তা দুই ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান, মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সবার বক্তব্যেই ছিল নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ। রাজনৈতিক সংকটের অচলাবস্থা যে এই নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশকে দীর্ঘায়িত করছে, সে কথাটিই তাঁরা বারবার বাংলাদেশি রাজনীতিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ওই সেমিনারেই একজন ব্রিটিশ এমপি জানালেন, বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, এইচ অ্যান্ড এম, আর্কেডিয়ার পক্ষ থেকে নিরাপত্তার বিষয়ে তাঁদের কাছে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। (সেদিনের প্রথম আলোতেই ছাপা হয়েছে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের একটি সাক্ষাৎকার, যাতে তিনি বলেছেন যে বিদেশিরা উদ্বিগ্ন নন, আমরা তাঁদের আশ্বস্ত করেছি।)

আলোচনায় বারবার এসেছে রাজনীতিতে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ দেওয়ার কথা, যেটি তাঁদের বিবেচনায় ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ১৪ হাজার (সরকারি হিসাবে ১১ হাজার) সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারের সংখ্যা যে আইনের শাসনের
সাক্ষ্য বহন করে না, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁরা নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ও সুশাসনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। বিদেশি আলোচকদের মধ্যে দুই মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিদের কথা না বললেই নয়। তাঁদের মধ্যে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্রাড অ্যাডামসের পর্যবেক্ষণ ছিল, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে মানবাধিকার রক্ষায় তাদের ভূমিকা থাকে খুব ভালো। কিন্তু সরকারে তারা বিএনপির পথেই হাঁটছে। বিরোধী দলে থাকার সময় র‍্যাব ভেঙে দেওয়ার কথা বললেও ক্ষমতায় থেকে ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগ বেড়ে চলেছে। আর অ্যামনেস্টির আব্বাস ফয়েজের কথায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে ক্ষমতায় গিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আগের চেয়ে বেশি খর্ব করেছে। সন্ত্রাসবাদের নতুন হুমকি সম্পর্কে আলোচনায় তারা তদন্তের আগেই বিরোধীদের ওপর দায় চাপানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। জঙ্গি–সন্ত্রাসে আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের আশঙ্কা শুরু থেকেই নাকচ করে দেওয়া হলে তদন্তের সীমারেখা টেনে দিয়ে মূল তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করা হয় কি না, সেই প্রশ্নও তাঁরা তোলেন।

বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতারা যথারীতি পাল্টাপাল্টি দোষারোপের অনুশীলন চালিয়ে গেলেও এবার একটি ব্যতিক্রম ছিল লক্ষণীয়। এই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বললেন, মৌলবাদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থান একটি বৈশ্বিক বিষয় এবং তা শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়। এ কারণে আমাদের সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। ধর্মীয় জঙ্গিবাদের সমস্যা যে একটি বৈশ্বিক বিষয়, এটি প্রকাশ্যে স্বীকার করার ক্ষেত্রে সরকারের মধ্যে একধরনের সংকোচ বা অনীহা থাকলেও এখন তারা তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর তা মোকাবিলায় সহযোগিতার কথাও তারা বলছে।

এই সেমিনারেই সরকারি একটি পুস্তিকা বিলি করা হয়েছে, যেটি স্পষ্টতই লেখা বিদেশিদের উদ্দেশে। জুলাই ২০১৬ সালের ইংরেজি এই প্রকাশনাটি এসেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। পুস্তিকাটিতে ব্লগার, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, পুলিশ কর্মকর্তা এবং সমকামী অধিকারকর্মী হত্যার ঘটনাগুলোর মোট ৫০টিকে বহুল আলোচিত মামলা বিবেচনা করে সেগুলোর তদন্ত, গ্রেপ্তার ও বিচারের বিষয়ে অগ্রগতির হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। এসব হামলার কয়টিতে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ এবং কয়টিতে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত, সেই হিসাবও এতে রয়েছে।

পুস্তিকাটির পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘ফেসিং দ্য ইমার্জিং চ্যালেঞ্জ অব ইন্টারন্যাশনাল টেররিজম’। এই লেখায় ইউরোপজুড়ে আইএসের চালানো হামলাগুলোর সঙ্গে গুলশানের জিম্মি সংকটের আপাতদৃশ্যে মিল পাওয়া যায় উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে আইএস ও আল-কায়েদা যে বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা করছে, তা অস্বীকার করা যায় না। এতে বলা হয়েছে, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) আইএসের সঙ্গে এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টের (একিউআইএস) সঙ্গে কোনো একধরনের যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, সেই সম্ভাবনা সরকার নাকচ করে দিচ্ছে না। ওই প্রকাশনায় আরও বলা হয়েছে যে গুলশানে গণহত্যার খুনিরা আইএসের সদস্য কি না, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের ধনী পরিবারের আধুনিক তরুণেরা কেন মৌলবাদের দিকে ঝুঁকছে, সেটি অনুসন্ধান করা। আন্তর্জাতিক পরিসরে সন্ত্রাসবাদ দমনে সরকারের অঙ্গীকার ও অংশগ্রহণের দৃষ্টান্ত হিসেবে সৌদি আরবের নেতৃত্বে ৩৪টি মুসলিম দেশের আইএসবিরোধী জোটে বাংলাদেশের শরিক হওয়ার তথ্যও এতে তুলে ধরা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে যে জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সক্ষমতা অর্জনে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ও বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছ থেকে সহায়তা নেবে।

বিদেশিদের আশ্বস্ত করার চেষ্টায় সরকারের এ ধরনের প্রকাশনার প্রয়োজন ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু তা যথার্থ এবং যথেষ্ট কি না, সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। দেশজ জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদীদের যোগাযোগের দাবিকে সরকার বিবেচনায় নিয়ে তদন্তের কথা বলেছে, এটি ভালো কথা। কিন্তু সৌদি জোটে অংশগ্রহণকে আইএসবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশের অঙ্গীকারের প্রতিফলন হিসেবে তুলে ধরার যুক্তিটা দুর্বল। সৌদি জোট সন্ত্রাসবাদবিরোধী ঠিকই, কিন্তু কতটা আইএসবিরোধী তা প্রশ্নবিদ্ধ। সৌদিদের প্রধান লক্ষ্য শিয়াপ্রধান ইরানের প্রভাববলয়কে ধ্বংস করা। যার বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইয়েমেনে শিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এবং একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের ওই জোটে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি। দেশের ভেতরে যেমন, বাইরেও তেমন জোড়াতালির প্রতিক্রিয়া কি কম তাজ্জবের ব্যাপার?

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক