তারুণ্য জরিপ: তরুণেরা কেন রাজনীতিবিমুখ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

প্রথম আলো জরিপে তরুণদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও সন্তুষ্টি আছে অর্ধেকের বেশি তরুণের মধ্যে। তবে জরিপমতে, রাজনীতিতে বাংলাদেশি তরুণদের অনাগ্রহ আগের চেয়ে বেড়েছে। এর বিপরীতে আগ্রহ বেড়েছে সামাজিক আন্দোলনে। ধর্মে বাংলাদেশি তরুণদের সুগভীর আস্থার প্রমাণ পাওয়া গেছে জরিপে। একই সঙ্গে ধর্মচর্চার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহও আগের তুলনায় বেড়েছে। এই জরিপে আকাশ থেকে পড়ার মতো নতুন কোনো চিত্র আসেনি। তবে শতাংশের হিসাবে তরুণদের ভাবনাগুলো পড়তে পারাটা আকর্ষণীয় বৈকি। তরুণেরা তাঁদের মনের কথা বলেছেন। ঠিকই আছে। আমি কিছু কিছু কথা একটু কম বুঝতে পেরেছি। তাই এই লেখা।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তরুণদের (৮০ শতাংশ) মধ্যে সন্তুষ্টি সরকারি মহলকে খুশি আর বিরোধীদের নাখোশ করবে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণের সন্তুষ্টি থেকে এটুকু বুঝতে পারছি যে তাঁরা বৈষম্য নয়; বরং আয়, তথা স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির নিরিখে অর্থনীতিকে দেখছেন। যাঁরা সমাজে-রাষ্ট্রে বৈষম্য বিলোপ না হলেও অন্ততপক্ষে বৈষম্য হ্রাসকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তাঁদের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। কারণ, এই তরুণেরাই সামনের দিনগুলোতে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। দশকের পর দশক ধরে চলমান লুটপাটের সংস্কৃতি না থাকলে আমরা কেমন থাকতাম, তা কি তরুণেরা মাথায় রেখেছিলেন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মত দেওয়ার সময়?

রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৫৪ শতাংশ) তরুণদের সন্তুষ্টিও চিন্তার কারণ। হানাহানি, হরতাল-অবরোধ নেই, এতেই খুশি? দলের ভেতরে গণতন্ত্র, দলের ভেতরে-বাইরে ভিন্নমতের চর্চা, দলের মধ্যে নারীদের জন্য সমান সুযোগ, কিংবা জনপ্রিয় হলেই একটি দল গণতান্ত্রিক কি না, এসব প্রশ্ন কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। এগুলো ভাবনায় থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণের সন্তুষ্ট থাকার কথা কি?

জরিপমতে, প্রায় ৫৭ শতাংশ তরুণ রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহী। আমার কাছে অবশ্য এটা ‘২০০ শতাংশ’ মনে হয়। রাজনীতিবিমুখতা-রাজনীতি বিরোধিতা হচ্ছে আজকের তরুণের অন্যতম সাধারণ প্রবণতা, তথা স্মার্টনেস। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে আবার নানান নেতিবাচক দিকের লম্বা একটা লিস্ট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। সন্দেহ নেই যে রাজনীতির মাঠ কর্দমাক্ত। প্রশ্ন হচ্ছে, মাঠ ঠিক করার কাজটা কাদের? তুমুল-তরুণদের অতীতে এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে দেখা গেছে।

আজকের তরুণ রাজনীতি আর রাজনীতিকের সমালোচনার মধ্যেই দায়িত্ব সারছেন কি? পরীক্ষায় ভালো ফল করা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা বলি রাজনীতি প্রসঙ্গে। তাঁদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, ভালো ফল করা ছাত্রছাত্রীদের ডেকে নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোতে বড় বড় পোস্ট-পজিশন দিতে হবে! এমন কথার মধ্যে মতাদর্শ কিংবা নিবেদনের কোনো ব্যাপার দেখি না। রাজনীতিতে মেধার দরকার নেই, এ কথা কে বলবেন? কিন্তু রাজনীতি কি কেবল মেধাবীদের পদ–পদবি পাওয়ার জায়গা?গণতন্ত্রের জন্য, উন্নততর একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষার মতো কথাগুলো আজকাল কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অথবা আজেবাজে হাতে পড়ে এসব শব্দ তাৎপর্য হারিয়ে ফেলছে। ক্লাসে যে দু–একজন থাকেন রাজনীতি করা, তাঁদের সবাই একটু অন্যভাবেই দেখেন বলে মনে হয়।

সামরিক শাসনামল থেকে শুরু হওয়া বিরাজনীতিকরণের প্রকৌশল কাজ করতে শুরু করেছে অনেক দিন থেকেই। এ ছাড়া সুশীল সমাজের প্রভাবশালী একটি অংশের মধ্যে রাজনীতিকে বিরাজনৈতিকভাবে আলোচনার লম্বা দম ফেলতে দেখি। তরুণদের রাজনীতিবিমুখতার মধ্যে এসবের প্রভাব আছে বলে মনে হয়।

সামাজিক আন্দোলনে আগ্রহ বেড়ে যাওয়াটা ইতিবাচক। পৃথিবীজুড়েই তরুণদের মধ্যে সামাজিক আন্দোলনে যুক্ততা বাড়ছে। অন্যায়ের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে এমনকি গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যেও অনেক সময় সীমাবদ্ধতা কাজ করে। দলীয় হিসাব-নিকাশের জায়গা থেকে জাতীয় স্বার্থকে দেখতে হয় অনেক সময়। এটা পছন্দ হয় না অসংখ্য তরুণের। এঁদের অনেকেই যুক্ত হয়ে যান সামাজিক আন্দোলনে। আজকের দিনের অনেক সামাজিক আন্দোলনই কিন্তু ব্যাপক অর্থে রাজনীতিক। জলবায়ু রক্ষা আন্দোলন, জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলন নয় কি?

ধর্মচর্চায় বাংলাদেশি তরুণেরা (প্রায় ৯৭ শতাংশ) সবিশেষ আগ্রহী। কিন্তু একটা জায়গায় একটু অবাক লাগছে। জরিপমতে তরুণদের একটি অংশ মনে করে, মোবাইল, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আড্ডা ও পরিবার থেকে যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা না করা, পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে অনেকে ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।

৯৭ শতাংশ তরুণ যেখানে ধর্মচর্চায় অনুরাগী, সেখানে এই ‘অনেক’ তরুণেরা কারা? আমাদের এক গবেষণাতে বেশির ভাগ উত্তরদাতা নিজের বা নিজেদের পরিচয় দেওয়া বা অন্যদের থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে সর্বাগ্রে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে জাতিসত্তা কিংবা নাগরিকত্বের পরিচয় অনেক পেছন থেকে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থেকেছে। তরুণ উত্তরদাতাদের মধ্যেও একই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এমতাবস্থায় আমার মনে প্রশ্ন এসেছে, যেসব তরুণ মনে করছেন ‘অনেক’ তরুণ ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছেন, তাঁরা আসলে কী বোঝাতে চাইছেন? আমার তো মনে হয় যে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ নিজ নিজ ধর্মের রজ্জু প্রতিদিন আরও শক্ত করে ধরছেন। শুধু আচার পালনের ক্ষেত্রে নয়, বরং জীবনের যেকোনো দিক নিরিখ বা ঠিক-বেঠিকের বিচারে ধর্মকেই তাঁরা একমাত্র লেন্স, একমাত্র নিক্তি হিসেবে ব্যবহার করছেন।

শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক