তারুণ্যের স্বপ্ন-সারথিরা হারায় না

ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত
ফাহিম সালেহ। ছবি: সংগৃহীত

১৫ জুলাই সকালটা অন্য রকম হয়ে গেল। কী মনে করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকেই একজন আইটি উদ্যোক্তার প্রোফাইলে ফাহিম সালেহর ছবি দেখে চমকে উঠি। তারপরই জানতে পারি জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বাংলাদেশের ‘পাঠাও’, নাইজেরিয়ার গোকাডা, কলম্বিয়ার পিকাপ-এর অন্যতম সহ-উদ্যোক্তা ৩৩ বছর বয়সী ফাহিম সালেহ নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে নিজের বিলাসবহুল কন্ডোমোনিয়ামে খুন হয়েছেন। খুনি শুধু তাঁকে খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে তাঁর মাথাসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। বৃহস্পতিবার দুপুর বেলা এই লেখার সময় পর্যন্ত খুনি গ্রেপ্তার হয়নি এবং খুনের কারণও জানা যায়নি। বুধবার দিনভর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মাধ্যমে এবং বিশেষ করে তরুণদের আড্ডায়–আলোচনায় ফাহিমের হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি তাঁর বয়সী তরুণদের পৃথিবীকে পাল্টে ফেলার উদ্যোগ নিয়েই বেশি আলাপ হয়েছে। 

আমার মনে পড়েছে, বছর তিনেক আগে আমার হাইস্কুলপড়ুয়া ছেলে একদিন আমার কাছে জানতে চেয়েছিল আমি কি এমন একজন বিনিয়োগকারীকে চিনি, যে কিনা পরিবর্তনের জন্য ‘থিং’ খোঁজে। আমার অবাক করা চাহনির জবাবে সে ফাহিম সালেহর কথা জানায় এবং তার সম্পর্কে আমাকে অবহিত করে। এর আগে পাঠাওয়ের তৃতীয় সহ-উদ্যোক্তা সম্পর্কে আমার তেমন কিছু জানা ছিল না। কিন্তু তার পরপরই খোঁজ নিয়ে আমি জানতে পারি কেন আমার হাইস্কুলপড়ুয়া ছেলের মতো মিলেনিয়াম প্রজন্মের কাছে ফাহিম বা ফাহিমের মতো তরুণেরা জনপ্রিয়। 

কারণ দুটো। একটা হলো এই প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তি খায়, তথ্যপ্রযুক্তি পরে, তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে থাকে এবং তথ্যপ্রযুক্তিকে দিয়েই কেবল নিজেদের নয়, সঙ্গের লোকদের জীবনও পরিবর্তন করতে চায়। দ্বিতীয়ত, ওরা কেউ প্রচলিত পথে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে না, নতুন পথ খুঁজে বের করে। মিলেনিয়ামদের সঙ্গে তার আগের তথা ফাহিমের প্রজন্মের একটাই পার্থক্য সেটি হলো ফাহিমদের আমলে তথ্যপ্রযুক্তির জন্য ভালোবাসা তৈরি করতে খুবই কষ্ট করতে হতো। 

ফাহিমের কথাই ধরা যাক। স্কুলে পড়ার সময় থেকে ফাহিম কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখতে শুরু করেন নিজে নিজে। তখন থেকেই এর মাধ্যমে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে ফাহিম নিজের পণ্য ও সেবা নিয়ে ভেবেছেন। অনেক অ্যাপভিত্তিক সমস্যা সমাধানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ফাহিমের প্রথম সফল উদ্যোগ ছিল প্রাঙ্কডায়াল ডট কম নামের একটি অ্যাপ। এর মাধ্যমে যে কেউ অন্য দুজনের সঙ্গে ‘প্র্যাকটিক্যাল জোকস’ করতে পারে বা ‘মজা’ করতে পারে। যেহেতু এই অ্যাপ আমেরিকার জন্য বানানো হয়, তাই ফাহিমকে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হতো না। তবে প্রায়ই তাঁকে পুলিশের ফোন সামলাতে হতো। ফাহিমই সম্ভবত এ ক্ষেত্রের অন্যতম উদ্যোক্তা, যিনি কিনা এ রকম অনলাইন কৌতুককে একটি সফল ব্যবসায় পরিণত করতে পেরেছেন। ফাহিমের মতো তরুণদের এ ধরনের ভিন্ন রকমের কাজ মিলেনিয়াম প্রজন্মকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তার একটি প্রকাশও আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক একটি মার্কিন জরিপে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ পেশা হিসেবে ‘ইউটিউবার’ হওয়ার কথা জানিয়েছে। 

তবে প্রাঙ্কডায়াল ডট কম নয়, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া বা কলম্বিয়ার লোকেরা ফাহিমকে মনে রাখবে আমাদের নড়াইলের মোটরবাইক শেয়ারিং, উত্তরবঙ্গের সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে যাত্রী পরিবহনের ‘হেলিকপ্টার সার্ভিস’ কিংবা ভিয়েতনামের মোটরসাইকেল-রিকশাসেবাকে এক আশ্চর্য জগতে পরিণত করে দেওয়ার জন্য। পাঠাও, গোকাডো কিংবা কলম্বিয়ার অ্যাপের সামাজিক প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী। আমাদের দেশে একটি দেশীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ৭০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রায় পাঁচ দশক ধরে কাজ করতে হয়। অথচ পাঠাও, সহজের মতো অ্যাপ মাত্র কয়েক বছরে শুধু ঢাকা শহরেই কয়েক লাখ তরুণের কাজের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু কর্মসংস্থান নয়, এর মাধ্যমে বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তনও সূচিত হয়েছে। আগে যিনি কিনা ভাগনে-ভাইপোর মোটরসাইকেলের পেছনে বসার জন্য কয়েকবার ভাবতেন, তাঁরাও অবলীলায় একজন অপরিচিত ‘রাইডারের’ পেছনে উঠে পড়ছেন!

 ফাহিমরা যে প্রজন্মের সন্তান, তাঁরা তাঁদের চল্লিশ পেরোনোর আগেই তিন তিনটি বিপ্লব দেখেছেন। তঁাদের চোখের সামনে লাখ টাকার কম্পিউটার হাতের নাগালে এসেছে, ইন্টারনেট দুনিয়াকে এক সুতায় বেঁধে ফেলেছে এবং স্মার্টফোন প্রান্তজনকে সংযুক্তির সাহস জুগিয়েছে। বুধবারের দিনভর আলোচনায় অনেকে প্রশ্ন করেছেন ফাহিম কেন একটি মাত্র উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেন না? আসলে তাঁর প্রজন্ম যে প্রযুক্তিবিপ্লবের মধ্যে বেড়ে উঠেছে, সেখানেই এর উত্তর রয়েছে। তারা দ্রুত পরিবর্তন আনতে চায়, তারা পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে চায়। সে জন্য তারা ‘চাকরি না খুঁজে, চাকরি দেব’ ভাবনাতেই নিজেকে এগিয়ে নেয়। ফেব্রুয়ারি মাসে ফাহিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘একটি দেশের পরিবর্তনের কাজটা করে উদ্যোক্তারা, তারাই আসলে শহরগুলোকে পাল্টে দেয়। তারাই আসলে রূপকল্প নিয়ে এগিয়ে আসে, তাদেরই থাকে পরিবর্তনের তাগিদ বা প্যাশন এবং তারাই আসলে মানুষকে একত্র করে অভাবনীয় সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে।’ 

ফাহিমের হত্যাকারীরা ধরা পড়ুক। উন্মোচিত হোক এ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সব রহস্য। পাশাপাশি ফাহিম ও ফাহিমের অনুসারী বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের নানা ‘উদ্ভট’ আইডিয়ার পাশেও আমরা দাঁড়াই, তাদের অনুপ্রেরণা দিই যেন তারা শহর কিংবা দেশকে পাল্টে দিতে পারে। তাহলে হয়তো ফাহিমের অতৃপ্ত আত্মা শান্তি পাবে। 

মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান প্রধান