তালুকদার ও খন্দকারের বাহাস এবং ভোটারদের কান্না

খন্দকার মোহাম্মদ নূরুল হুদা ও মাহবুব তালুকদার

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন নামে যে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, ভোটের মাঠে তা বোঝার উপায় নেই। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার খন্দকার মোহাম্মদ নূরুল হুদা এবং তাঁর সহযোগী কমিশনাররা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেন। না হলে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন নামের বিশাল ভবনটিতে কেউ আছেন, তা উপলব্ধি করা কঠিন হতো।

নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব এখন কেন্দ্রে সকালে ভোটের বাক্স পাঠানো, কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের নামে মোটা অঙ্কের ভাতা নেওয়া এবং রাতে ফল ঘোষণার মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়েছে। বাকি যে কাজ অর্থাৎ ভোট গ্রহণ, ভোটারদের নিরাপত্তা, প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলানো, কেন্দ্রের বাইরে ও ভেতরে ভোটের পরিবেশ রক্ষা করা, এসব নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

গত মঙ্গলবার ছিল ভোটার দিবস। নাগরিকের ভোটাধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই দিবসটি পালন করা হয়। এ উপলক্ষে কে এম হুদা কমিশনের পদাধিকারীরা নিজ কার্যালয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন, যা পরিণত হয়েছে তালুকদার ও খন্দকারের বাগ্‌যুদ্ধে। নির্বাচন কমিশনের অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদার সম্প্রতি কয়েকটি নির্বাচনের উদাহরণ তুলে ধরে বলেছেন, নির্বাচনে এখন আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা সমতল মাঠ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীদের মধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকা দরকার। কেননা কারও জন্য মাঠ সমতল, কারও জন্য অসমতল হলে খেলা হয় না।

কিন্তু হুদা কমিশন নির্বাচনটি এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে, যেখানে মাঠটাই উধাও হয়ে গেছে। মাহবুব তালুকদার সতর্ক করে দিয়েছেন এ অবস্থা চলতে থাকলে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি রাউজান প্রভৃতি এলাকার উদাহরণ টেনে বলেছেন, সেখানে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়ে গেছেন তাঁরা।

যেখানে প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হন, সেখানে নির্বাচনী কর্মকর্তা কিংবা নিরাপত্তারও প্রয়োজন নেই। তবে তালুকদার সাহেবের কথা শুনে কারও কাছে ঠাট্টা মনে হতে পারে। কেননা নির্বাচনী ব্যবস্থা তো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
কিন্তু মাহবুব তালুকদারের এই মৃদু সত্যবচনও সহজভাবে নিতে পারেননি সিইসি নূরুল হুদা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে ভদ্রলোক ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না। ভেতরে-ভেতরে যে এত দিন রাগ ও ক্ষোভ পুষেছিলেন, এবার তার বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন। বললেন, মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনকে অপদস্থ ও হেয় করতে এসব কথা বলেছেন। শুরু থেকেই নাকি তালুকদার ব্যক্তিস্বার্থে এসব কাজ করে আসছেন। তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করছেন না বলেও মন্তব্য করেছেন সিইসি।

কিন্তু খন্দকার সাহেব এ কথা বলেননি যে তালুকদার কোনটি অসত্য বলেছেন। কমিশন যদি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারত, তাহলে কারও কথায় নির্বাচন কমিশনের গায়ে দাগ লাগত না। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি এভাবে হেয় বা অপদস্থ হতো না। তাদের সম্মিলিত অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতার কারণেই নির্বাচন কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে।

মাহবুব তালুকদার হয়তো বিবেকের দংশনে মৃদু স্বরে হলেও কিছু সত্য কথা বলেছেন। অন্যদের মতো অন্যায়ের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেননি। কিন্তু ব্যর্থতার দায় তিনিও এড়াতে পারেন না।

সিইসির ভাষায়, নির্বাচন কমিশন যদি হেয় ও অপদস্থ হয়ে থাকে, তার জন্য কমিশনের পদাধিকারীরা দায়ী। তাঁরা সম্ভবত পূর্বসূরি এম এ আজিজ কমিশন, রকিব কমিশন কিংবা সাদেক কমিশনের কথা ভুলে গেছেন। দেশের মানুষ তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করে? এর মধ্যে আজিজ কমিশন নির্বাচনই করতে পারেনি। আর রকিব কমিশন ও সাদেক কমিশন নির্বাচন করলেও তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। রকিব কমিশনের যুক্তি ছিল বিরোধী দল নির্বাচন (২০১৪) বর্জন করলে তাদের কী করার আছে। কিন্তু হুদা কমিশনের ক্ষেত্রে সেই কৈফিয়তও নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশ নিয়েছে। তারপরও তারা একটি অবিশ্বাস্য ভোট দেশবাসীকে ‘উপহার’ দিলেন। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে হেয় করেছেন। সুষ্ঠু ভোটের উদাহরণ এলে যেমন মানুষ ১৯৯১, ২০০৮-এর কথা বলে, তেমনি জবরদস্তির নির্বাচনের কথা এলে ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের কথাও বলবে।

সিইসি বলতে পারেন, নির্বাচনে যাঁরা হেরে যান, তাঁরা ভোট কারচুপি বা জালিয়াতির অভিযোগ আনেন, ইভিএম নিয়ে সন্দেহ করেন। কিন্তু মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি, যারা ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে, তারা কী বলে?

খন্দকার সাহেব যেদিন নির্বাচন কমিশনের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য সভা ডেকেছিলেন, সেদিন জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমদ ওরফে বাবলু সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা জিতেছে, হেরেছে ভোটাররা। ভোট দিতে না পেরে ভোটাররা রাস্তায় কান্না করছেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না। নির্বাচনে ইভিএম মেশিনে শতভাগ ভোট পড়ছে, এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইভিএমকে আওয়ামী ইভিএমে পরিণত করা হয়েছে। ইভিএম পরিচালনায় জড়িত ব্যক্তিদের পরিবর্তন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, গণমানুষের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে জাতীয় পার্টি কখনো মাথা নত করবে না। প্রহসনের নির্বাচন বন্ধ করতে সংগ্রাম চলবে। ভোটের নামে সন্ত্রাস হচ্ছে, নৈরাজ্য হচ্ছে, কেন্দ্র দখল হচ্ছে, মানুষের প্রাণহানি ঘটছে—এটা বন্ধ করতে হবে।

নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চান কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের লাজ-লজ্জা থাকলে তাদেরই উচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া। জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ টি ইউ তাজ রহমান বলেন, প্রমাণ হয়েছে নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ডহীন। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন কর্মকর্তারা কার্টুনের মতো আচরণ করছেন। আর পুলিশ প্রশাসনের আচরণ আওয়ামী লীগের কর্মীদের মতো।

খন্দকারের নেতৃত্বাধীন কমিশন গত চার বছরে একটি কাজ বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে করেছে, মানুষকে ভোটবিমুখ করা। অথচ বাংলাদেশের মানুষ সেই ব্রিটিশ আমল থেকে ভোটকে নিয়েছে অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে। এর প্রমাণ তারা ১৯৪৬ সালে দিয়েছে, ১৯৫৪ সালে দিয়েছে, ১৯৭০ সালে দিয়েছে, ১৯৯১ সালে দিয়েছে, ১৯৯৬ সালে (১২ জুন), ২০০১ ও ২০০৮ সালে দিয়েছে।

ভোটার দিবসে তালুকদার ও খন্দকারের বাহাস শেষের শুরু না শুরুর শেষ সেই প্রশ্নের উত্তর কেবল ভবিষ্যৎই দিতে পারে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]