তালেবানকে যে কারণে আইএস দমন করতেই হবে

আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় সবচেয়ে বড় শহর কুন্দুজের খান আবাদ এলাকার গোজার-এ-সাইয়েদ আবাদ মসজিদে ৮ অক্টোবর জুমার নামাজের সময় ভয়াবহ বোমা হামলা হয়। এই মসজিদ শিয়া সম্প্রদায়ের। হামলায় তাৎক্ষণিকভাবে মারা গেছেন ৪৬ জন। আহত হয়েছেন বহু মানুষ। হামলার পর ইসলামি স্টেট খোরাসান (আইএস-কে) এর দায় স্বীকার করেছে। আইএস-কে বলেছে, হামলাকারীর নাম মোহাম্মাদ আল উইঘুরি। এই নাম সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। হামলাকারী যে উইঘুর সম্প্রদায়ের লোক এবং তাঁর সঙ্গে যে উইঘুর মুসলমানদের প্রধান আবাসস্থল চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের একটা যোগসাজশ আছে, তাঁর নামের মধ্যেই সে ইঙ্গিত আছে। একজন চীনা উগ্রপন্থী আফগানিস্তানের শিয়া মসজিদে হামলা চালিয়েছেন—এ তথ্য বেইজিং এবং তেহরানের চোখ কপালে তোলার জন্য যথেষ্ট।

জাতিসংঘ গত জুনে এক প্রতিবেদনে আফগানিস্তানে ৮ থেকে ১০ হাজার ‘বিদেশি সন্ত্রাসী যোদ্ধা’ আছে বলে জানিয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এঁরা প্রধানত মধ্য এশিয়া, রুশ ফেডারেশনের উত্তর ককেশীয় অঞ্চল, পাকিস্তান এবং চীনের জিনজিয়াং থেকে এসেছেন। ওই প্রতিবেদন বলছে, যদিও এই বিদেশি যোদ্ধাদের বেশির ভাগেরই তালেবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, কিন্তু তাঁদের অনেকেই আছেন, যাঁরা আল–কায়েদাকে সমর্থন করেন অথবা আইএসআইএল কিংবা আইএস-কের প্রতি তাঁদের সহমর্মিতা আছে। আইএসআইএল হলো ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ট। আর এর আফগান ‘শাখা’ হলো আইএস-কে বা ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান।

২০১৯ সালে তুরস্কে কয়েকজন উইঘুর যোদ্ধার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ইস্ট তুর্কমেনিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টসহ (ইটিআইএম) কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা ছিলেন। সেই ইটিএম এখন তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি (টিআইপি) নামে পরিচিত। জাতিসংঘ ২০০২ সালে ইটিআইএমকে সন্ত্রাসী তালিকায় নিয়ে আসে। সিরিয়ায় যুদ্ধ চলার সময় ইটিআইএমের একটি বড় অংশ সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তে চলে আসে। এখন টিআইপি সিরিয়ার ইদলিবে ঘাঁটি গেড়েছে।

তালেবান কাবুল দখল করছে—এটি যখন স্পষ্ট হয়ে গেল, তখনই পশ্চিম চীন, তাজিকিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার জিহাদিরা ইদলিব ছেড়ে আফগানিস্তানে চলে আসে। ইটিআইএমের নেতা আবদুল হক এখনো সিরিয়ায় আছেন। তিনি আল–কায়েদারও শুরা কাউন্সিলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কুন্দুজের শিয়া মসজিদে হামলার চার দিন আগে, অর্থাৎ ৪ অক্টোবর ইরানের একটি প্রতিনিধিদল আফগানিস্তানে এসেছিল। তারা মূলত আফগানিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য এবং আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের নিরাপত্তা নিয়ে তালেবান শাসকদের সঙ্গে আলাপ–আলোচনা করতে এসেছিল।

তালেবানের দিক থেকে ইরানকে পূর্ণ আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে, তারা আইএস-কে কিংবা কোনো গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দেবে না এবং ইরানে হামলার জন্য আফগানিস্তানের মাটি কাউকে ব্যবহার করতে দেবে না। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে তালেবান নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের কথা রেখেছে বলে দেখা যাচ্ছে। কুন্দুজের শিয়া মসজিদে হামলার আগের দিন আফগানিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী মৌলভি আবদুল সালাম হানাফি শিয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে ৮ অক্টোবরের হামলায় শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে গেছে। এ কারণে ইরানের আস্থা অর্জনে তালেবানকে আইএস-কে দমনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

শিয়া মসজিদে হামলাকারী যে উইঘুর সম্প্রদায়ের লোক এবং তাঁর সঙ্গে যে উইঘুর মুসলমানদের প্রধান আবাসস্থল চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের একটা যোগসাজশ আছে, তাঁর নামের মধ্যেই সে ইঙ্গিত আছে। একজন চীনা উগ্রপন্থী আফগানিস্তানের শিয়া মসজিদে হামলা চালিয়েছেন—এ তথ্য বেইজিং এবং তেহরানের চোখ কপালে তোলার জন্য যথেষ্ট।

চীনের সমর্থন ধরে রাখাও এখন তালেবানের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। তালেবান চীনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আফগানিস্তানের মাটি থেকে কোনো চীনবিরোধী তৎপরতা চলতে দেওয়া হবে না। কিন্তু আইএস-কে উইঘুর মুসলিমদের দলে ভিড়িয়ে চীনবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯০–এর দশকে তৎকালীন তালেবান সরকার আফগানিস্তানে ইটিআইএম এবং অন্য উইঘুর গ্রুপগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিল। তবে এবার মনে হচ্ছে তালেবান তাদের আর সেভাবে প্রশ্রয় দেবে না।

চলতি বছরের শুরুতে ইটিআইএম যোদ্ধারা সিরিয়া থেকে আফগানিস্তানের বাদাখশান প্রদেশে চলে আসেন। বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ওই প্রদেশের জনবহুল ওয়াখান করিডরে তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন। এই করিডর সোজা চীনের দিকে চলে গেছে। ফলে এটি চীনের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়েছিল। তবে সম্প্রতি তালেবানের নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁদের আফগান-চীন সীমান্ত এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এই যোদ্ধারা এখন আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া তালেবান সব উইঘুর মুসলিমকে চীনের হাতে তুলে দেবে, এমন গুজব ছড়ানোর পর উইঘুর যোদ্ধারা এখন গা ঢাকা দিয়েছেন।

গত আগস্টে ইতালির পত্রিকা লা রিপাবলিকার সাংবাদিক মাত্তিয়া সোরবি তালেবানের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে জবিউল্লাহ বলেছেন, চীন আফগান সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে। তিনি বলেছেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প বাস্তবায়নে সমর্থন দিয়ে যাবে। কাবুলের দক্ষিণের মেস আইনাক তামার খনি থেকে তামা উত্তোলনে চীন দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দিতে যাচ্ছে। জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, চীনের সহায়তায় এই খনি আবার প্রাণ পাবে এবং খনিটিতে সর্বাধুনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

আফগানিস্তানের দুই পাশ দিয়ে বিআরআই যাবে। দেশটির উত্তরাঞ্চল দিয়ে যে বাণিজ্য পথ যাবে, সেটি তাজিকিস্তান হয়ে ইরানে চলে যাবে। আর চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর গেছে আফগানিস্তানের দক্ষিণ পাশ দিয়ে। ওয়াখান করিডরের মুখ হবে বিআরআইয়ের তৃতীয় রুট। এটি যাবে কাবুল থেকে ইরান (মধ্য এশিয়া ও রাশিয়ার বাজারে পাকিস্তানের কৃষিপণ্য যাওয়ার সংযোগ পথ হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হবে)। এসব কারণে চীন ও ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কাবুলের জন্য সুচিন্তার পরিচায়ক হবে না।

চীন ও ইরানের সঙ্গে তালেবান সরকারের ঘনিষ্ঠতায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেও চিন্তিত। এ কারণে ওয়াশিংটন কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছে। তবে সে ক্ষেত্রে তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বড় ধরনের স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে অর্থ নিউইয়র্কে অথবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে জমা আছে, তা তোলার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র স্থগিতাদেশ দিয়ে রেখেছে। ওই স্থগিতাদেশ তুলে নিলে তালেবান সরকার অনেকটাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে। তবে সবার আগে আইএসের মতো শক্তি দমন করাই তালেবান সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

বিজয় প্রসাদ ভারতীয় ইতিহাসবিদ, লেখক ও সাংবাদিক