তালেবানের দলীয় দ্বন্দ্ব মেটাতে এই মন্ত্রিসভা?

তালেবানের নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ হাসান আখুন্দ কাবুলে সাংবাদিকদের সামনে
ছবি: এএফপি

তালেবানের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ, দল–উপদল আছে। এ কারণে তাদের সরকার গঠনে বেশ কয়েক দিন সময় লেগে গেল। সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া সোজা। কিন্তু জাতিসংঘ ঘোষিত একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে গতানুগতিক একটি ইসলামি আমিরাতের সরকারে রূপান্তরিত করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় অনেক কঠিন কাজ।

তালেবানের নতুন সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, দেশ চলবে শরিয়া আইনে। তার মানে নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী খর্ব করা হবে। ধর্মীয় বিধানকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। এই সরকারে একজন সর্বোচ্চ নেতা বা আমির থাকছেন। তাঁর নিচের দিকে থাকছেন তাঁর একদল উগ্রপন্থী সহযোগী। এই নতুন মন্ত্রিসভায় যাঁরা থাকছেন, তাঁদের ৭০ শতাংশই জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী সন্ত্রাসী।

ইসলামি আমিরাতের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন মোল্লা হয়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা। তাঁর নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারকে এখন পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।

তালেবান স্পষ্টতই দুই ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগ কান্দাহারকেন্দ্রিক, আরেক ভাগ পক্তিকাকেন্দ্রিক। কান্দাহারকেন্দ্রিক তালেবানই হচ্ছে আদি তালেবান। কান্দাহারভিত্তিক মাদ্রাসাছাত্রদের নিয়ে এই ভাগ গড়ে উঠেছিল। আর পূর্ব আফগানিস্তানের পক্তিকাভিত্তিক তালেবানের যে দল রয়েছে, সেটি গঠিত হয়েছে মূলত হক্কানি নেটওয়ার্ক ও হেকমতিয়ার গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে। এটি পাকিস্তানসংলগ্ন এলাকা এবং এই পক্তিকা উপদলের সদস্যরা প্রকৃত তালেবান বা মাদ্রাসাছাত্রদের নিয়ে গঠিত উপদল নয়। এঁরা যুদ্ধবাজ নেতাদের ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করে আসছিলেন।

কান্দাহার তালেবান এবং পক্তিকা তালেবানের মধ্যে প্রথম থেকেই আদর্শগত কিছু বিভেদ আছে। কোন পক্ষ ক্ষমতার কতটুকু পাবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে চাপা উত্তেজনাও ছিল। তালেবানের শীর্ষ নেতৃত্ব এই দুই পক্ষের ‘মন’ রেখে মন্ত্রিসভা সাজানোর চেষ্টা করেছেন।

মন্ত্রিসভার দিকে তাকালে আমরা দেখব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাঁকে বসানো হয়েছে, সেই মোল্লা মোহাম্মাদ হাসান আখুন্দ তালেবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তালেবানের সাবেক প্রধান মোল্লা মোহাম্মাদ ওমরও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। ১৯৯৬ সালে কান্দাহারের খিরকা শরিফে সংরক্ষিত মহানবী (সা.)–এর খিরকা বা জোব্বা এনে তিনি মোল্লা ওমরকে উপহার দিয়েছিলেন এবং এর মধ্য দিয়ে রাতারাতি মোল্লা ওমরকে সাধারণ জনগণের নেতা বানিয়ে দিয়েছিলেন।

যেহেতু পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সব সময় বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। সে কারণে এই পদে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত কাউকে রাখা হয়নি। এই পদে নিযুক্ত হয়েছেন আমির খান মুত্তাকি।

এখন পর্যন্ত হাসান আখুন্দ তালেবানের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ ‘রেহবারি শুরা’র একজন সম্মানিত সদস্য। তিনি প্রথম থেকেই আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপের ঘোরবিরোধী। জাতিসংঘের সন্ত্রাসী তালিকায় তাঁর নাম আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কান্দাহার তালেবান এবং হক্কানি ও হেকমতিয়ার নেটওয়ার্ক—এই সব গ্রুপের কাছেই তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। ফলে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা নিয়ে তালেবানের মধ্যে যে বিবাদের আশঙ্কা ছিল, তা হাসান আখুন্দ শেষ করে দিয়েছেন।

মোল্লা হাসান আখুন্দের দুজন ডেপুটির একজন হলেন আবদুল গনি বারাদার, যিনি পশতুন বংশোদ্ভূত। আরেক ডেপুটি হলেন মৌলভি আবদুল সালাম হানফি, যিনি উজবেক বংশোদ্ভূত। হানফি এখনো ন্যাটোর মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় আছেন। এই দুজনই পাকিস্তানের জেলখানায় দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন। কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে তাঁরা ছাড়া পেয়েছিলেন। পশতুন ও উজবেক—এই দুই নেতাকে দুই উপপ্রধানমন্ত্রী বানিয়ে তালেবান জাতিগত ভারসাম্য ঠিক রাখার চেষ্টা করেছে।

এই মুহূর্তে তালেবান সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর এর মন্ত্রী হিসেবে নিয়োজিত হয়েছেন হক্কানি গ্রুপের প্রধান সিরাজুদ্দিন হক্কানি। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর মাথার দাম ৫০ লাখ ডলার ঘোষণা করেছিল। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক বহুদিন থেকে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তালেবানের যাবতীয় কার্যক্রম মূলত তাঁর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। কাবুল দখল ও পানশির আক্রমণ তাঁর নিয়ন্ত্রিত বাহিনীর মাধ্যমেই হয়েছে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন মোল্লা মোহাম্মাদ ওমরের ছেলে মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব। তিনি তালেবানের সামরিক শাখার প্রধান। তিনি দোহায় আলোচক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। তালেবানের উভয় গ্রুপের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে তাঁর অনেক আগে থেকেই যোগাযোগ আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যাতে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, সে লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন।

যেহেতু পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সব সময় বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। সে কারণে এই পদে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত কাউকে রাখা হয়নি। এই পদে নিযুক্ত হয়েছেন আমির খান মুত্তাকি। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তালেবানের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন এবং দোহা আলোচকদের মধ্যেও তিনি অন্যতম ছিলেন। তাঁর ডেপুটি হলেন শের মোহাম্মাদ আব্বাস স্তানিকজাই, যিনি ভারতের দেরাদুনের মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। মুত্তাকি ও স্তানিকজাই দুজনই তালেবানের সব দলের কাছে শ্রদ্ধাভাজন হিসেবে বিবেচিত।

তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যাঁকে, তিনি হলেন খাইরুল্লাহ সাঈদ ওয়ালি খাইরখাওয়া। তিনি দীর্ঘদিন গুয়ানতানামো বে কারাগারে বন্দী ছিলেন। তালেবানের হাতে আটক হওয়া মার্কিন সেনা বোয়ি বার্গডালের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে মুক্তি দিয়েছিল। আল–কায়েদা নেতা উসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আর তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ।

তালেবান মনে করছে, এই মন্ত্রিপরিষদ তাদের সব উপদলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। যদি তাই হয়, তাহলে হয়তো তালেবান তাদের অন্তর্কোন্দলের চ্যালেঞ্জ ঠিকমতো মোকাবিলা করতে পারবে। কিন্তু অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ অন্য দিকগুলোতে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে, তা তারা কতটুকু মোকাবিলা করতে পারবে, তা সময়ই বলতে পারবে।

দ্য ইকোনমিক টাইমস থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনূদিত

অমিত বানসাল ভারতের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর