তাহলে নির্বাচনটা হচ্ছে!

বাংলাদেশের ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলগুলো যখন একে অপরের সঙ্গে বসে কথা বলাকে মস্ত গুনাহের কাজ মনে করছে, তখন আগামী নির্বাচন নিয়ে নুরুল হুদা কমিশনের প্রায় তিন মাসব্যাপী সংলাপ উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করি। তারা কেবল বিবদমান অথবা জোটভুক্ত ৪০টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেই বৈঠক করেনি, কথা বলেছে সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সাংবাদিক, নারী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও।

আরও কৌতূহলোদ্দীপক হলো, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপ করে দুই বিপরীত মেরুতে (প্রকৃতই বিপরীত মেরুতে কি না, সে বিষয়ে অনেকে সন্দিহান) অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা খুশিতে ডগমগ করছেন। তাঁদের এই খুশির সঙ্গে যদি কমিশন আগামী নির্বাচনতক ভোটারদের খুশি রাখতে পারে, সেটি হবে তাদের জন্য বড় অর্জন। আর যদি না পারে, তাহলে এসব খুশি বুদ্‌বুদের মতো হাওয়ায় উড়ে যাবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা ও চার কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, শাহাদাত হোসেন চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাই। তাঁরা অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য শুনেছেন। এ পর্যন্ত কমিশনের কাছে ৪০০ সুপারিশ জমা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে সিইসি জানিয়েছেন। এখন ইসির কাজ হবে এসব সুপারিশ পর্যালোচনা করে সবার অংশগ্রহণে যাতে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়, সে বিষয়ে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একটি মন্তব্য আওয়ামী লীগ মহলে কিছুটা প্রতিক্রিয়া দেখালেও সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করে বিষয়টি নিয়ে তারা মাঠ গরম করেনি। তবে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশির মতো আবদুল কাদের সিদ্দিকী সেই অজুহাতে ইসির সঙ্গে আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করে এসে বললেন, ‘সংলাপ বর্জন করলাম।’ শুনেছি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কৈশোরে উল্টো দৌড়ে বাজিমাত করেছিলেন। আমাদের রাজনীতিতে উল্টো দৌড়ের লোক যে এখনো আছেন, জনাব সিদ্দিকীই তার প্রমাণ।

নুরুল হুদা সাহেব আরও একটি কারণে বাড়তি ধন্যবাদ পেতে পারেন। তিনি তাঁর পূর্বতন বক্তব্যে অনড় রয়েছেন। বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন, ‘জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন, এমন বক্তব্য এখনো ওউন (ধারণ) করেন কি না?’ এ প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘হ্যাঁ। এখনো ওউন করি। আমি বলেছিলাম, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন, প্রতিষ্ঠা নয়। তাঁর আগে বহুদলীয় গণতন্ত্র ছিল। (জিয়াউর রহমানের সময়ে) গণতন্ত্র আবার ফিরে এসেছে। সেই ভিত্তিতে ১৯৭৯ সালে বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ বহু দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। বহু দল সংসদে যোগ দিয়েছিল। বহু দল সংসদ পরিচালনা করেছিল। কাউকে খুশি করার জন্য নয়, তথ্যভিত্তিক বলেছি।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ অক্টোবর ২০১৭)।

নির্বাচনে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চাপ এলে তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবেন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাছে সরকার বা কোনো মন্ত্রী, এমপির কোনো চাপ আসেনি। তবে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে চাপ এসেছে, যা সব সময় আসে। কখনো রাজনৈতিক দল পুলিশ বা প্রিসাইডিং কর্মকর্তার বিষয়ে ফোন করেছে। তখন যথার্থতা যাচাই করে ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু কখনো সরকারের পক্ষ থেকে আলাদা করে চাপ আসেনি। ভবিষ্যতে চাপ এলে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করব।’

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে আইনে কোনো পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, আইনে পরিবর্তন আনার দরকার নেই। আশা করি, বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে। আমরা আন্তরিকভাবে চাই বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে আসুক। কারণ, বিএনপি একটি বড় দল। আমরা বিশ্বাস করি, আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।’ (সূত্র: ওই)

এ ছাড়া সিইসি সেনা মোতায়েন, নির্বাচনী কাজে ইসির কর্মকর্তাদের নিয়োগ, মাঠপর্যায়ের প্রশাসন ইত্যাদি নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, সেসব নিয়ে এখন চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসেনি। অতীতে দেখেছি, সাংবিধানিক পদাধিকারীরা সুন্দর সুন্দর কথা বলে যে কাজটি করেছেন, তা ছিল মন্দ। আর সাবেক সিইসি কাজী রকিব কাজ ও কথা—দুই ক্ষেত্রেই নজির স্থাপন করেছেন। তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থাটি চুরমার করে দিয়ে বলেছেন, নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। বর্তমান সিইসি সেই পথে না গিয়ে বলেছেন, ‘নির্বাচন শেষ না করা পর্যন্ত আমরা ভারমুক্ত হই না। ভার তো আমাদের ওপর থাকবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে। সেগুলো সমাধান করতে হবে।’

নির্বাচনী আইনে কী আছে, সেসব নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কমিশনের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতাও রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সেই ক্ষমতা ও আইনের প্রয়োগ তাঁরা সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে করতে পারবেন কি না? নির্বাচনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে সিইসি দাবি করেছেন। আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে তো সব দলের সভা-সমাবেশ করার যে গণতান্ত্রিক অধিকার, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এক পক্ষ মাঠে-ময়দানে প্রচার চালাবে, আরেক পক্ষকে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না, আর বলা হবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটি আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়।

বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মালিবাগ-মগবাজার উড়ালসড়কের শেষাংশ উদ্বোধনকালে আগামী বছরের শেষ নাগাদ পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন হতে বাকি ১২ থেকে ১৩ মাস। আগামী ডিসেম্বর থেকেই একধরনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশন আশা করছে, বিএনপিসহ সব দল নির্বাচনে আসবে। দেশবাসীও চায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে, এ রকম একটি নির্বাচন। ২০১৪ সালের মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দায় রাজনীতিকেরা নেবেন না বলেই ধারণা করি। ২০১৪ সাল থেকে এখনকার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হলো, সে সময়ে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল বিএনপি নির্বাচনে না আসুক। আর বিএনপি মনে করেছিল, তারা নির্বাচনটি ঠেকাতে পারবে। এবার দুই দলের মনোভাব হলো আওয়ামী লীগ ধরে নিয়েছে বিএনপি নির্বাচনে আসবে এবং সেভাবেই তারা (আওয়ামী লীগ) প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর বিএনপির নেতারা মনে করছেন, জনমত যখন তাদের পক্ষে আছে, তখন আন্দোলনের অংশ হিসেবে হলেও নির্বাচনে যাওয়া উচিত।

তবে বিএনপির বড় দুশ্চিন্তা হলো দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা। নির্বাচনের আগে মামলার নিষ্পত্তি হবে কি না। নিষ্পত্তি হলে রায়ে তাঁর শাস্তি হয় কি না। তবে দুর্নীতির মামলায় নিম্ন আদালতে শাস্তি হলেও তা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বাধা হবে না। নিম্ন আদালতের শাস্তি মাথায় নিয়ে যদি আওয়ামী লীগের নেতারা মন্ত্রিত্ব করতে পারেন, খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন না কেন?

নির্বাচনে সব দলই জয়ী হতে চায়। যিনি সবচেয়ে কম ভোট পান, তিনিও মনে করেন, জিতেও যেতে পারেন। না হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কেন? কথা হলো, দেশের প্রধান যে দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তারা কি দলীয় সমর্থকদের ভোটে নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে পারে? যদি সেটি পারত, তাহলে প্রতিবারই জয়ী হতো। আগের চারটি নির্বাচন (২০১৪ নয়) হিসাবে নিলে দলীয় ভোট ৩২ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। ১৯৯১ থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে জিততে হয়েছে দলীয় বৃত্তের বাইরের ভোট নিয়ে। আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের কিংবা বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে যতই ষড়যন্ত্রের আলামত দেখুক না কেন, ভোটের হিসাবই বলে দেয়, কীভাবে দোদুল্যমান ভোট কখন কাকে বেছে নিয়েছে অথবা প্রত্যাখ্যান করেছে। যাঁদের ভোটে ২০০১ সালে বিএনপি জয়ী হয়েছিল, তাঁরাই ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দিয়েছেন। ২০১৪ সালে আরেকটি পরীক্ষা ছিল। সেই পরীক্ষায় বিএনপি অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। এই সরল অঙ্ক মনে রাখলে দুই দলের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব অসার প্রমাণিত হয়।

আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে নেতারা মহা দুশ্চিন্তায় আছেন, তাঁদের ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সম্প্রতি প্রকাশিত দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স (১৯৯৬-২০১২) বইটি পড়ে দেখার অনুরোধ করব। বইটি পড়লে নিজেদের দুর্বলতা ও সবলতা অনুধাবন করতে পারবেন (আর যেসব বিজ্ঞজনের পড়ার সময় নেই, তাঁরা আগামী কয়েক দিন প্রথম আলোর পাতায় চোখ রাখবেন)। ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বইটি যে বাংলাদেশের পাঠকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তার কারণ লেখকের নির্মোহ ও দলনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি দলের দুর্বলতা যেমন অকপটে স্বীকার করেছেন, তেমনি ভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীদের ভালো কাজের প্রশংসা করতে দ্বিধা করেননি। কোথাও নিজের কৃতিত্ব জাহির করেছেন বলে মনে পড়ে না।

বই প্রকাশের পর ১৮ অক্টোবর নিসতুলা হেব্বারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রবীণ কংগ্রেস নেতা অকপটে স্বীকার করেছেন, ঐতিহাসিকভাবে জোটবিরোধী কংগ্রেস অটল বিহারি বাজপেয়ির জোট সরকারের সাফল্য থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০৪ সালে নির্বাচনী জোট করে জয়ী হয়েছিল। আবার ২০১৪ সালে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি আমাদের নেতা-নেত্রীদের মতো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আবিষ্কার করেননি। বলেছেন, ‘প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে, কেন জনগণ আপনাকে সমর্থন করছেন। দ্বিতীয়ত, ভাবতে হবে কেন জনগণ আপনার ওপর আস্থা হারাচ্ছেন এবং সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন? এটি গণিতের হিসাব নয়; এটি হলো জীবন্ত মানুষ নিয়ে কাজ। স্বভাবতই আপনাকে তাঁদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হবে।’

আমাদের বিজ্ঞ রাজনীতিকেরা কি একবার আয়নায় মুখ দেখবেন? কেন জনসমর্থন বাড়ে, কেন কমে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখবেন। নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার কতটা পূরণ করেছেন, একবার নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। তাহলে প্রতিবার নির্বাচন নিয়ে এই যে অবাঞ্ছিত উত্তেজনা ও অনৈতিক যুদ্ধের মহড়া, তা ৯০ শতাংশ কমে যাবে।

যা কিছু লিখলাম আগামী নির্বাচনকে উপলক্ষ করেই। তাহলে নির্বাচনটা হচ্ছে!

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।