তিনি ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা

প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান

শহীদ জিয়ার ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। এই ক্ষণজন্মা সিংহ পুরুষকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে মর্মান্তিকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। তাঁর অপরাধ, তিনি দেশকে বুক উজাড় করে ভালোবেসেছিলেন, জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে কঠিন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন জাতিকে একটি মর্যাদাবান ও গৌরবোজ্জ্বল সোপানে পৌঁছে দিতে। ৩৫ বছর আগে ঠিক আজকের এই দিনে ঘৃণ্য ঘাতকেরা তাঁকে হত্যা করে বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্য দুর্বল ও পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল। তারা জাতির সম্মান ও গৌরব ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। জাতিকে এক নৈরাজ্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল।
জিয়া একটি ইতিহাস। জিয়া একটি প্রতিষ্ঠান। জিয়া একটি বৈপ্লবিক চেতনা। জিয়া একটি রাজনৈতিক দর্শন। আজ জিয়া সম্বন্ধে দুটি কথা বলতে গিয়ে প্রথমে সৈনিক জিয়ার কথা বলতে চাই। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধরত ডিভিশনের একটি ইউনিট ছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। অধিকাংশ বাঙালি সৈনিক ও অফিসার নিয়ে গঠিত এই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রচণ্ড সাহসিকতার সঙ্গে জীবন-মরণ সংকল্প নিয়ে চরম রণদক্ষতা প্রদর্শন করে সেই সেক্টরে ভারতের আগ্রাসনকে ঠেকিয়ে দেয়। গোটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে রেজিমেন্টের কৃতিত্ব কিংবদন্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন জিয়া এই রেজিমেন্টের (প্রথম ইস্ট বেঙ্গল) ছিলেন কোম্পানি অধিনায়ক। তাঁর কোম্পানি এই কৃতিত্বের এক বড় দাবিদার।
এরপর ১৯৭১। ক্যাপ্টেন জিয়া থেকে মেজর জিয়া। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার স্পৃহায় পাগলপারা। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী জ্বালাও–পোড়াও আর গণহত্যায় মত্ত। এমনি এক পরিস্থিতিতে ইথারে শোনা গেল জিয়ার সেই কণ্ঠস্বর। গোটা জাতিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানালেন। তিনি এ ঘোষণা প্রথমে তাঁর ব্যক্তিগত নামে, পরবর্তী সময়ে তা সংশোধন করে জাতীয় শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পুনরায় ঘোষণা করেন। শুধু ঘোষণা দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন, ফোর্স সংগঠিত করলেন, যুদ্ধাস্ত্র ও রণসম্ভার সংগ্রহ করলেন এবং প্রচণ্ড সাহসিকতায় যুদ্ধ পরিচালনা করলেন। দেশকে স্বাধীন করতে এক বড় ভূমিকা রাখলেন।
সৈনিক জিয়া মহান। বৃহত্তর ক্যানভাসে জাতীয় পরিসরে রাষ্ট্রনায়ক জিয়া আরও অনেক মহান। ১৯৭৫ সালে এক মহা অস্থিরতার মধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। জাতির ভাগ্যাকাশে অনেক দুর্যোগ নেমে আসে। জাতিসত্তার উদ্গাতা ও উন্মেষক স্বাধীনতার মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো এই নেতা এক ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। একাত্তরের মার্চে লাখো জনতার মাঝে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘আমাদের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কী অদ্ভুত নিয়তি! কী বিচিত্র এ দেশ! রক্তমাখা হাতে তাঁরই দলের অন্যতম নেতা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেন আকস্মিক ও অতর্কিতে। গভীর এক অনিশ্চয়তা, মহা এক অস্থিরতা নেমে আসে সারা দেশে, সেনাবাহিনীতে ও সেনানিবাসগুলোয় এর অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়ে। ঘটনার ক্রমবিবর্তনে এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থান ঘটে। আর তারই উত্তাল তরঙ্গমালায় জাতির সেই মহাশূন্যতায় জেনারেল জিয়া উঠে আসেন জাতির শীর্ষ নেতৃত্বের পাদপ্রদীপে।
জিয়া গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা। জিয়া এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, যে দেশটি নিজের পায়ে দাঁড়াবে। বিশ্বসভায় হিমালয়ের উচ্চতায় দৃশ্যমান থাকবে বাংলাদেশের শির। জিয়া জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি।
জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার সময়কাল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত—মাত্র পাঁচ বছর বা তার একটু বেশি। এই স্বল্প সময়ে তিনি যুগান্তকারী সব বড় কাজ করে গেছেন। জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে, প্রতিটি বিষয়ে একটা বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পরিচয়ের সংকটে আক্রান্ত জাতিকে তিনি
পরিচয় দিয়েছিলেন। জিয়ার বড় অবদান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত তার চেতনা ও রাজনৈতিক দর্শন।
জিয়ার এক বড় অবদান তাঁর রচিত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাঁর দূরদৃষ্টি, বৈপ্লবিক চেতনা, বিশ্বাস ও স্বাধীনচেতা দৃঢ় চরিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মহান গণচীনসহ কয়েকটি বড় দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে। সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে জেনারেল জিয়া গণচীন সফর করেন। আমি বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে হিসাবে মাত্র যোগদান করেছি। জেনারেল জিয়াকে চীনা সরকার, চীনা জনগণ অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেয়। বিপুলভাবে সম্মানিত করে। মাও সে-তুংয়ের তিরোধানের পর তখন চীনের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান হুয়া কুয় ফেং। আমি হুয়া কুয় ফেংকে উচ্ছ্বসিতভাবে জেনারেল জিয়ার প্রশংসা করতে শুনেছি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চয়তায়, অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের পূর্ণ সহযোগিতার দৃঢ় আশ্বাস তিনি ব্যক্ত করেন।
আমার মনে পড়ে, বেইজিং থেকে বিদায় নেওয়ার সময় জিয়াউর রহমান হাত বাড়ালেন হ্যান্ডশেকের জন্য। আমার হাতে শক্ত করে চাপ দিলেন। বেইজিং বিমানবন্দরের টারমার্কে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির সেই করমর্দনের স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘Mahbub, I am leaving, you will be here. China is our friend. China is a great country. Develop our relations, promote the friendship. Remember, this is the country to which we look forward, this is the country in which we can fully trust.’ কে জানত জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সেই হবে আমার শেষ সাক্ষাৎ? তাঁর বিদায়বেলার কথাগুলো এখনো আমি শুনতে পাই। আমার কানে অনুরণিত হয়।
তখনো আমি বেইজিংয়ে। ১৯৮১ সালের ৩০ মের ভোরবেলা আমার বাসার টেলিফোনটি অনবরত বেজে চলছিল। এত ভোরে কখনো কেউ কল দেয় না। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ঢাকা থেকে হবে হয়তো কোনো দুঃসংবাদ। রিসিভার তুলতেই চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফরেন লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল সু চুইন ফিংয়ের পরিচিত গলা। ‘আপনি কি জানেন আপনাদের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াকে আজ গভীর রাতে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়েছে? কারা করেছে? কেন করেছে? তিনি আমাদের একজন খাঁটি বন্ধু ছিলেন...।’ আমি স্তম্ভিত। আমি বাক্রুদ্ধ।
আজ শহীদ জিয়ার ৩৫তম শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করছি। আরাম-আয়েশ আর বিলাসিতার বিপরীতে কঠোর কৃচ্ছ্রতার জীবন তিনি যাপন করতেন। ব্যক্তিচরিত্রে কোনো অনৈতিকতা, ভ্রষ্টচারিতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি তাঁকে কখনোই এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি। জেনারেল জিয়ার চরিত্রের সবচেয়ে বলিষ্ঠ দিক ছিল, তিনি স্তুতিবাক্য একদম পছন্দ করতেন না। তাঁর পরিবারের সদস্যরা, তাঁর স্বজনেরা তাঁকে সরকারি কাজে কখনো এতটুকুও প্রভাবিত করতে পারেননি। স্বজনপ্রীতি কখনো তাঁকে স্পর্শ করেনি।
জেনারেল জিয়ার চরিত্রের এই দিকটিই আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছিল। আজও যখন এ ঘটনা মনে পড়ে, তাঁর উদ্দেশে আমার ডান হাতটা অজান্তেই কপালে উঠে আসে। একটি চৌকস স্যালুট করে বসি। যেমনটি করেছিলাম বেইজিং বিমানবন্দরে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাতে।
আজ জিয়ার ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান।