তিস্তার ভাঙন, নির্বিকার সরকার

তিস্তার ভাঙন থেকে বাঁচতে ঘর সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে মানুষ

সম্প্রতি তিস্তা নদীর ভাঙন সরেজমিন দেখার জন্য কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার গতিয়াশাম নামক স্থানে গিয়েছিলাম। নদীর প্রায় এক কিলোমিটার আগেই দেখলাম, একটি স্থানে কাদামাটির ওপর বেশ কিছু নতুন ঘর উঠছে। কাদামাটির ওপর ঘর কেন করছেন জিজ্ঞেস করতেই এক নারী বললেন,Ñ‘সোগ নদীত ভাসি গেইচে। কোন্টে থাকমো?’ তিস্তায় বাড়িঘর হারিয়ে সেখানে বেশ কয়েক ঘর এসে ঠাঁই নিয়েছে। আরও অনেক ঘরের চাল, বেড়াসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আনার কাজ তখনো শেষ হয়নি।

বাড়িঘর সব নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। অশ্রুসিক্ত হওয়া মানুষগুলোর দিকে তাকানো যায় না। এই কষ্ট যদি আমাদের জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের কর্তারা উপলব্ধি করতেন, তাহলে তাঁরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। যাঁদের হাতে সমাধান, তাঁরা থাকেন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাড়িগাড়িতে; নদীতীরবর্তী বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন কিলোমিটার দূরে।

গতিয়াশামের প্রায় দেড় হাজার বাড়ি চলতি বর্ষায় নদীগর্ভে বিলীন। আরও কত এলাকা এবার নদীগর্ভে বিলীন হবে তা অনুমান করা যাচ্ছে না। গতিয়াশামের ওপর দিয়ে এখন তিস্তা প্রবাহিত হচ্ছে। সরকারের পক্ষে যেন খবর নেওয়ার কেউ নেই। স্থানীয় বৃদ্ধ আবদুল খালেক অভিযোগ করে বললেন, ‘নদী তো এমনিতেই ভাঙে, তার ওপর গত বছর মেশিন দিয়ে এক জায়গা থাকি অনেক বালু তুলছে। সেই জন্যে বেশি ভাঙছে নাকি কে জানে।’ দেখলাম, নদীর কিনারে কয়েকটি ঘর থেকে জিনিসপত্র বের করা হয়েছে। একটি ঘর ভাঙা বাকি। সেটি খুলে নিয়ে যাওয়া হবে। ওই দিন ওই বাড়িতে থাকার শেষ দিন। পাশেই যাঁর বাড়ি ছিল, তাঁরাও চলে গেছেন। ওই বাড়ির গৃহকর্ত্রী গেলেন সবার শেষে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনি নতুন ঠিকানায় চললেন। যাওয়ার আগে বারবার ভাঙা উঠানের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেলেন।

তিস্তা নদীকে বলা হয় পাগলি বা পাগলা নদী। নদীটি কখন কী আচরণ করে, বলা কঠিন। কোনো অনুমানই খাটে না। গত বছর রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় তীরবর্তী একটি স্থানে গিয়ে দেখেছিলাম, অনেকগুলো বাড়ি ভেঙে নিয়ে গেছে, সেখানেই আবার বিশাল চর জেগেছে। স্থানীয় বৃদ্ধ মুনসুর আলী বললেন, ‘একটা গ্রাম ছিল। কয় দিনেই পুরো গ্রামই নদীত চলি গেইচে। কয় দিন পর আবার ওই জাগাতে চর জাগি উঠচে।’

এ বছর রংপুর অঞ্চলে বৃষ্টি কম ছিল। উজানের পানিও আসে কয়েক দিন পরপর। পানি কম হলেও ভাঙন কম নেই, বরং কিছুটা বেশি। প্রতিবছর কতগুলো বাড়ি ভাঙে, কত আবাদি জমি নদীতে যায়, কোনো পরিসংখ্যান নেই। অনুমান করা যায়, ৪০ থেকে ৫০ হাজার বাড়ি বছরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লাখো গাছ ভেসে যায় নদীতে। বলতে গেলে ক্ষতির অর্থমূল্য শত শত কোটি টাকা।

এ বছর বর্ষার শুরুতেই খবর পাচ্ছিলাম, তিস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী, সাধারণ সম্পাদক সফিয়ার রহমানসহ কয়েকজন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় গিয়েছিলাম। ওই স্থানে অপর প্রান্তে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা। সুন্দরগঞ্জের খানিকটা এলাকা পড়েছে প্রায় আট কিলোমিটার প্রস্থ তিস্তার বাঁ দিকে চিলমারী প্রান্তে কাশিমবাজারে। কাশিমবাজারে তখন তীব্র ভাঙন। যেহেতু গাইবান্ধার অংশে ভাঙছে, তাই কুড়িগ্রাম কিংবা লাগোয়া উলিপুর-চিলমারী উপজেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি তখন পর্যন্ত তাদের কোনো সহায়তা দেয়নি। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তত দিন পর্যন্ত সেখানে তাঁদের কেউ পরিদর্শনেও যাননি।

বাড়িঘর সব নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। অশ্রুসিক্ত হওয়া মানুষগুলোর দিকে তাকানো যায় না। এই কষ্ট যদি আমাদের জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের কর্তারা উপলব্ধি করতেন, তাহলে তাঁরা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। যাঁদের হাতে সমাধান, তাঁরা থাকেন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাড়িগাড়িতে; নদীতীরবর্তী বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন কিলোমিটার দূরে।

তিস্তার ভাঙন রোধে সরকারের কার্যকর কোনো পদেক্ষপ নেই। অনেক সময় স্থানীয় বাসিন্দারা চাঁদা তুলে ভাঙন ঠেকাতে কাজ করে থাকেন। যেমন এ বছরেই রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বিনবিনিয়ার চরে স্থানীয় লোকজন প্রায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা তুলে একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি আর উজানের ঢলেই সেটি ভেসে গেছে। সরকার প্রতিবছর বন্যার মৌসুমে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে বালুর বস্তা ফেলার মতো সান্ত্বনামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এতে কখনোই ভাঙন বন্ধ করা সম্ভব নয়। তিস্তার এক স্থানে ভাঙন বন্ধ হলে আরেক স্থানে ভাঙে। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, বস্তায় উপকার হয়েছে। বাস্তবে শুধু টাকাই নষ্ট। ভাঙন যা হওয়ার তা-ই হয়।

বর্তমান খাতে প্রবাহিত তিস্তার বয়স মাত্র ২৩৪ বছর। ১৭৮৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় এ নদীর বর্তমান খাতের সৃষ্টি হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, তিস্তা নদীর বয়স অনেক কম। ভূ-আন্দোলনের কারণে এ নদীর সৃষ্টি। এখনো কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্থির না হওয়ায় নদীটি ক্রমাগত তার স্থান পরিবর্তন করে যাচ্ছে। ভাঙন রোধ করতে হলে এসব বিষয় মাথায় রেখে কর্মসূচি নিতে হবে।

দুই পাড় উজাড় করে তিস্তা নদী ক্রমাগত প্রস্থে বাড়ছে। ২ কিলোমিটারের নদী এখন ১০ থেকে ১২ কিলোমিটারে পরিণত হয়েছে। তিস্তার ভাঙন রোধে আজ পর্যন্ত সরকার কোনো দিন কোনো বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এমনকি যাঁরা ভাঙনের শিকার, তাঁদের পাশেও সরকার নেই। ২৩৪ বছরের ইতিহাসে এ নদীর পরিচর্যা করারও তেমন কোনো ইতিহাস জানা যায় না।

বর্তমানে নদীর তলদেশ অনেক স্থানে পার্শ্ববর্তী সমতলের চেয়ে অনেক উঁচু। পানির প্রধান প্রবাহ যেদিকে যায়, সেখানে ভাঙন আর ভাঙন। শোনা যায়, তিস্তা নদী ঘিরে সরকার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছে। সেটি কখন হবে, কত দ্রুত হবে নাকি কোনো দিনই হবে না, জানা নেই। তবে তিস্তা-তীরবর্তী জনজীবন তথা তিস্তার সুরক্ষার জন্য সরকারকে অবশ্যই দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই অর্থের জন্য বিদেশের ঋণের ওপর নির্ভর না করে দেশীয় অর্থায়নে হলেও করতে হবে। তিস্তা নদী সুরক্ষায় যে টাকা ব্যয় হবে, নদীর ভাঙন আর বন্যা রোধের মাধ্যমে এক বছরেই তার চেয়ে অনেক বেশি টাকার সম্পদ রক্ষা হবে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

[email protected]