তীরভাঙা ঢেউ আর নীড়ভাঙা নদী

নদী শুধু একটি ভবন গিলে খায়নি, সেই সঙ্গে ভেঙে দিয়েছে শত শত শিশুর স্বপ্ন
নদী শুধু একটি ভবন গিলে খায়নি, সেই সঙ্গে ভেঙে দিয়েছে শত শত শিশুর স্বপ্ন

অনেক বছর আগের কথা। তখন শৈশব, ইশকুলে পড়ি। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম তাঁর জন্মভূমি দেখতে, অজপাড়াগাঁয়ে। ঢাকায় ফিরছি মোটরলঞ্চে করে। লঞ্চ ধীরগতিতে এগোচ্ছে মেঘনা দিয়ে। এত বড় নদী, এত চওড়া, আগে দেখিনি। পরে দেখেছি, মেঘনার চেয়েও চওড়া নদী আছে এ দেশে।

লঞ্চের ভটভট আওয়াজ শুনেই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে যায় অনেক মানুষ। আমার চোখ পড়ল নদীর পাড়ে। পাড় একেবারে খাড়া। মনে হয় জলের ওপর ৯০ ডিগ্রির সমকোণে সোজা দাঁড়িয়ে। একটু পরপর পাড় ভেঙে মাটি পড়ছে নদীর জলে। কী সুন্দর মসৃণ ছাইরঙা মাটি! তখন আমি বুঝিনি, এই মাটি ভেঙে পড়া মানে গেরস্তের সর্বনাশ। অনেক বছর পর কাজ করতে গিয়ে কিছু শব্দের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে—হাইড্রোলজি, মরফোলজি এই সব। নদী কেন তীর ভাঙে, এটা জানার চেষ্টা করেছি। ‘তীরভাঙা ঢেউ আর নীড়ভাঙা ঘর’—গানের এই সুর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু কত যে ঘর ভাঙে! 

কদিন ধরে ভারী বর্ষা হানা দিয়েছে। করোনার সংবাদে ছেয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমের ফাঁকফোকর গলে উঁকি দিচ্ছে বন্যা আর নদীভাঙনের খবর। খবরের কাগজে একটি স্কুলের খুব সুন্দর পাকা দালানের ডুবে যাওয়ার ছবি দেখে আঁতকে উঠেছি। নদী শুধু একটি ভবন গিলে খায়নি, সেই সঙ্গে ভেঙে দিয়েছে শত শত শিশুর স্বপ্ন, যারা অনেক বছর পর ছাপরাঘর ছেড়ে একটি সুন্দর পরিবেশ পেয়েছিল লেখাপড়া করার। আবার কবে এমন ইশকুল হবে?

আবহমানকাল থেকে নদীতীরেই গড়ে উঠেছে জনপদ। দুটি কারণে। নদীর পাড় সচরাচর উঁচু হয়। বর্ষায় নদীর জল উপচে আশপাশে ছড়ায়। জলের সঙ্গে আসে পলি। সেই পলি জমে জমে জমির উচ্চতা বাড়ায়। সেখানে মানুষ ঘর বাঁধে। জল ছাড়া জীবন অচল। সে জন্য মানুষ সব সময় জলের উৎসের কাছাকাছি থাকতে চায়। পৃথিবীর সব দেশেই দেখা গেছে নগর গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। আমাদের দেশে শুধু নগর নয়, গ্রামগুলোও নদীকে ঘিরে। নদী যখন দেয়, মুঠো ভরে দেয়। যখন আঘাত করে, সব মিসমার করে দেয়। এ জন্য পদ্মার নাম হয়েছে কীর্তিনাশা। কত যে কীর্তি তার ঢেউয়ের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

নদীভাঙা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বেশি নেই। গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বরে ঢাকার দ্য ডেইলি স্টার-এ একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। সেখানে কিছু তথ্য পেয়েছি, গা শিউরে ওঠার মতো। ২০১৯ সালে আনুমানিক ২৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীর পেটে চলে যাবে বলে একটি আভাস ছিল। নদীভাঙনের ফলে এ দেশে বছরে ৫০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে নাসা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৬৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা গিলে খেয়েছে পদ্মা, যার আয়তন শিকাগো শহরের সমান।

বাংলাদেশে জনঘনত্ব আর নদীঘনত্ব দুটোই বেশি। নদীতীরের ১২ হাজার কিলোমিটার এলাকা ভাঙনপ্রবণ। দেশের ৬৪টি জেলার ৬১টিতেই এই উপদ্রব। বছরের পর বছর দেশের মানুষকে লড়তে হচ্ছে নদীর সঙ্গে। তার খবর আমরা কয়জন রাখি? 

নদীর সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। এখানে যমুনা, পদ্মা, মেঘনা খুব বড় নদী। এত চওড়া নদী পৃথিবীতে খুব কম। যমুনার চেয়ে চওড়া নদী পৃথিবীতে একটাই আছে, আমাজন। আমাদের নদীগুলো এখনো বুনো। তাদের কল্যাণেই এ অঞ্চলে তৈরি হয়েছে বদ্বীপ। একদিকে গড়ছে, অন্যদিকে ভাঙছে। নতুন চরে গজানো ধানের সবুজ খেত দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। শত বছরের পুরোনো জমির বসতভিটা নদী খেয়ে ফেললে একমুহূর্তেই কত সম্পন্ন গৃহস্থ সর্বহারা হয়ে যান। এটা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে

এই তো নদীর খেলা

সকালবেলা আমির যেজন

ফকির সন্ধ্যাবেলা।

প্রশ্ন হলো, এটা কি আমরা মেনে নেব? জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কি আমাদের বাঁচাতে পারে না? ভূতত্ত্ববিদ ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা হয়তো ভালো জবাব দিতে পারবেন।

আমার সাদাচোখে যেটি ধরা পড়ে তা হলো মানুষ যখন নদীর কাছাকাছি বসতি গড়ে, সে জানে না ১০-২০-৫০ বছর পর কিংবা তারও পরে তার বসত নদীতে চলে যাবে কি না। এ পূর্বাভাস এ দেশের কোনো প্রতিষ্ঠানই দেয় না। অন্যদিকে নদীর কাজ নদী করে চলেছে। তাকে তো পানি বয়ে নিয়ে যেতে হবে। পলি আর বালু জমে জমে তার পেটে মেদ জমেছে। পানিপ্রবাহের জন্য নদীর পেটে থাকে চ্যানেল। অনেকটা আমাদের শরীরের শিরা-উপশিরার মতো। এই চ্যানেলগুলো স্থান বদলায়। চ্যানেল পলিতে ভরে গেলে তার জল তীরকে আঘাত করে বেশি। জলকে তো সামনে যেতেই হবে, সমুদ্রের কাছে। এটাই তার ধর্ম।

এর মধ্যে মুশকিল আসান হয়ে এল বাঁধ। এটা আরেকটা ধাঁধা। এর মাধ্যমে মানুষকে যা বোঝানো হয়, এককথায় তা হলো ফলস সেন্স অব সিকিউরিটি, নিরাপত্তার ভুল বার্তা। বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ যতটা কার্যকর, নদীভাঙন রোধের ক্ষেত্রে ততটা নয়। এই সত্যটা যাঁরা জানেন, তাঁরাও খোলাসা করে বলেন না।

আমাদের নদীগুলোর মতো এত আঁকাবাঁকা নদী ভূভারতে নেই। এটাও বদ্বীপ অঞ্চলের একটি বৈশিষ্ট্য। আঁকাবাঁকা হওয়ার কারণেই জলস্রোত বাধা পায় বেশি। ভাঙনও তাই বেশি। নদীগুলো কেটে সোজা করে দিলে হয়তো সমস্যা কমে যেত। কিন্তু এ তো দুঃসাধ্য। একটি-দুটি নদীর কিছু অংশ এভাবে কেটে সোজা করে দেওয়া যায়। যেমনটি করা হয়েছিল কালনী-কুশিয়ারায়। এটাকে বলে লুপ-কাট। এটা হয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে। বড় পরিসরে এমন করা যাবে বলে মনে হয় না।

নদীশাসন বলে একটি কথা চালু আছে। যমুনায় সেতু তৈরির সময় সেতু নিরাপদ রাখার জন্য দুই পাশে নদীর পাড় বাঁধাই করা হয়েছে কংক্রিটের ঢাল দিয়ে। সেতুর খরচের চেয়ে এর খরচ ছিল বেশি। পদ্মা সেতুতেও একই কাজ হচ্ছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে যে সেতু বানানো হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে সেতুর দুই পাড়ে নদীকে পোষ মানাতে। 

যে কথা বলছিলাম। মানুষকে বাঁধের কথা বলে একধরনের মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়। স্থানীয় নেতারা নির্বাচনের সময় বাঁধের প্রতিশ্রুতি দেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ তৈরি করে। অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা বরাদ্দ করে। ঠিকাদার সবাইকে খুশি করে তার প্রাপ্য বুঝে নেয়। তারপর দেখা যায়, বাঁধ আর নেই। প্রমত্ত নদীর আঘাতে তা তলিয়ে গেছে। মাটির বাঁধের এই হলো পরিণতি।

তাহলে আমরা কী করব? ইচ্ছা থাকলে অনেক কিছুই করা যায়। নদী তো প্রকৃতির দান। মানুষ পয়সা খরচ করে এটা বানায়নি। এখানে রাষ্ট্রের কোনো বিনিয়োগ নেই। নদীর জল মানুষ পানের জন্য কিংবা কৃষিকাজে ব্যবহার করে। নদীতে নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ চলে। বিনা পয়সায় পাওয়া এই নদী ব্যবহার করতে হলে তো এর রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। সেটি আমরা করি না। এর জন্য দরকার ড্রেজিং।

এ দেশে ড্রেজিংয়ের নামে তেল চুরির খবর আসে গণমাধ্যমে। নদী খননের জন্য ড্রেজার কেনার উদ্দেশ্যে ঠিকাদারেরা লাফঝাঁপ দেয়, যেনতেন একটা গছিয়ে দেওয়ার জন্য। অথচ পরিকল্পিত ড্রেজিং ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এটা তো রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় এক নম্বরে থাকার কথা। 

তারপরও নদীকে বাগে আনা যাবে না। তখন কী হবে? নদী যাদের উদ্বাস্তু করে, তাদের জন্য থাকতে হবে পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন। যারা ভিটে হারায়, তাদের অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে। তার ঘর বাঁধার বন্দোবস্ত করতে হবে। যার জীবিকা চলে গেছে, তার জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি ধরে নিই প্রতিবছর ১০ হাজার পরিবার নদীভাঙার কারণে সর্বস্বান্ত হয়, তাহলে এই পরিবারগুলোর জন্য যথোপযুক্ত পুনর্বাসনব্যবস্থা থাকতে হবে। স্পিডবোটে কিংবা হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে ১০ কেজি চাল আর দুটি শাড়ি-লুঙ্গি দিয়ে তো সমস্যার সমাধান হবে না। পরিকল্পনা কমিশনে এ নিয়ে কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না।

টেলিভিশনের পর্দায় নদীভাঙনের শিকার অসহায় মানুষগুলোর কান্না দেখে নিজেকে অভিশাপ দিতে ইচ্ছা করে—আমরা তাঁদের জন্য কি কিছু করেছি? মানুষ জানে, বিপদের সময় রাষ্ট্র তাঁদের পাশে দাঁড়ায় না। তাঁরা ডাকেন আল্লাহকে। আর আমাদের রাষ্ট্র ও তার কর্তারা! আমরা উন্নয়নের জাল বুনতে থাকি, অর্জনের ফানুস ওড়াই। হতভাগা মানুষের কান্না চাপা পড়ে থাকে ক্রোড়পত্রের আড়ালে। 

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক