তুই এসে দেখে যা বন্ধু

ছেলে পাবজি খেলার ভিডিও গেমে ইচ্ছেমতো মানুষ মারছে। মেয়ে টিকটকে ওত পাতা আড়কাঠিদের ফাঁদে চালান হয়ে গেছে। কিশোরেরা ‘গ্যাং’-এ নাম লেখাচ্ছে, ইয়াবা খাচ্ছে, কেউ কেউ ধরা পড়ছে। তবে কি আগামী তিন বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বোট ক্লাবে অঘটন। বোবায় ধরেছে ফিরে আসা যুবকদের।

এদিকে নিহত মুনিয়ার কথা কেউ আর বলছে না। কাঠঠোকরারা ঠোক ঠোক করে কেটে ফেলছে সিন্দুক। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ। আঙ্কটাড বলছে, বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১১ শতাংশ। কিন্তু গাড়ি ঠিকই চলবে কর্ণফুলী টানেলে। টানেলে গাড়ি, সড়কে নৌকা নিয়ে চট্টগ্রামবাসী বলবে, এই বেশ ভালো আছি। উপনির্বাচন চলছে, ক্লাব চলছে, ফেসবুকে দুই মন্ত্রীর বিবাদ চলছে, সড়কে নৌকা চলছে, কিন্তু খুলছে না স্কুল।

মেয়ে নাকি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মেরে ফেলেছে মা-বাবা আর বোনকে। স্বামীকেও রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ‍খুলনায় পুলিশের এসআই গুলি করে মেরেছে বউ আর তার বন্ধুকে। ইউপি নির্বাচনে এক দিনে তিনজন খুন। পাহাড়ে নওমুসলিম মরে গেছে গুলিতে। ১১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকার জমি বেহাত।

সুনামগঞ্জের শাল্লায় হামলাকারী স্বাধীন মেম্বারের জামিন। অথচ ফেসবুকে লিখেছে কি লেখেনি, শাল্লার হিন্দু যুবক ঝুমন দাসের জামিন নেই। এবারের ঈদেও জামিন পাচ্ছেন না ছাত্র অধিকার পরিষদের ৪৩ জন। মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে গেলেও টিকা নেই, কাজ নেই, খাবার নেই, অক্সিজেন নেই। মজুরির দাবিতে শ্রমিকেরা হয়ে যান লাশ। নিঃস্ব হয়ে প্রবাসীদের ফেরা থামছে না। বিদেশে টাকা পাচারও কমছে না।

এবারের বর্ষায় মেট্রোরেলের তলায় চলছে নৌকা। ধানমন্ডিতে ধান না থাকলেও ধানের জমির মতো ভাসা পানি। অসহায় হয়ে নাকি ভূমি দখল করে, বলছেন মেয়র। কবি বলছেন, ‘ফুল-পাখি-লতা-পাতা, তুমি কেন বলো না কথা।’ কথা বলতে গিয়ে জেলে শিক্ষক ও ছাত্র এবং তার চেয়েও ছোট যারা।

এদিকে করোনা ওয়ার্ডে আরও আরও মৃত্যু, মায়ের বুকে শিশু, ছেলের বুকে বাবা, ভাইয়ের বুকে ভাই বলছে, দম নিতে পারছি না। ওয়াসার এমডির বেতন সোয়া ছয় লাখ টাকা, প্রতি মাসে বৈশাখী বোনাস। চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডিও আরও বেতন চান। এদিকে ১৩ বছরে পানির দাম বেড়েছে ১৪ বার, বিদ্যুতের দাম ১১ বছরে হয়েছে দ্বিগুণ। উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ কাকে দেওয়া হবে, তা নিয়ে পিডিবি হয়রান।

পাউবো জানে না ঝড়ে ভাঙা বাঁধ ঠিক করা হবে কি না। তাই নদীর পাড়ে জনতার ঢিল খেয়ে সেন্টিমেন্টাল সাংসদের গলায় প্ল্যাকার্ড, ‘ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই’। আরও বেশি সুবিধা চাই, বলছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। বেড়েছে খুন, বেড়েছে ধর্ষণ, শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। সমাজটা কোথায় হারাল, তার নিখোঁজ সংবাদটাও কোথাও পড়িনি। কেবল দেখি লেখা আছে ভবনে ভবনে আর কাঁটাতারে, ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’। তনু বা সাগর-রুনি হত্যার দায় কাউকেই দেওয়া হয়নি।

না চাইতেও বাজেটে অনেকের বেতন বেড়েছে বেশি। কিন্তু সোয়া পাঁচ কোটি মানুষের দৈনিক আয় নিচে নেমে গেছে। করোনায় সারা দেশের মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও চা—এই চার খাতের ৮০ শতাংশ শ্রমিকেরই মজুরি পড়ে গেছে। গত এক বছরে দেশের আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন।

মহামারির মধ্যে দেশের ৫০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এত কিছুর পরও মাথাপিছু আয় নাকি ১৭ হাজার টাকা করে বেড়েছে! সমস্যা সবই চিহ্নিত, তবে সমাধান কিছু হয়নি। সকালে উঠে পড়ছি ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির দুর্ধর্ষ কাহিনি। জেনেছি, ক্যাসিনোতে প্রাইভেট কক্ষ ভাড়া নিয়ে সাজানো জুয়া খেলেছিলেন হ্যাকাররা।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বিদায় নেওয়ার আগে ২০২০ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই শতাধিক দুর্নীতির অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দায়মুক্তি দেন। অভিযুক্ত অনেকেই এখন বলবেন, ‘আমিও কিছু করিনি। কই, আমরাও তো কিছু শুনিনি।’ যদিও ফেসবুকে নিয়মিত লাইভে আসছেন নানা মুনি।

তবু তুই কেন আসছিস না নিখিলেশ। দেখে যা কেমন করে আমরা বেঁচে আছি। জানি, সুনীলের তুই উৎপল কুমার বসুর মতো করে বলবি, ‘বন্ধু, তোমার হাতের ওপর হাত রাখলেই আমি টের পাই তোমার বাজারে অনেক দেনা, ছেলেটা উচ্ছন্নে গেছে, মেয়ে রাত করে বাড়ি ফেরে, আজ যা-বলার আছে তুমি আমাকেই বলো, স্ত্রীর মুখরতার কথা বলো, সহকর্মীদের শঠতার কথা বলো, রাতে ঘুম হয় না, সেই কথা বলো, আর যদি কাঁদতেই হয় তবে এই কাঁধে মাথা রেখে কাঁদো, বন্ধু।’
বন্ধু, তুই এসে দেখে যা আমরা কেমন করে বেঁচে আছি।

(লেখাটি গত এক সপ্তাহে প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনামের ভিত্তিতে রচিত)

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]