তুরস্কের সঙ্গে ইউরোপের টানাপোড়েন

তুরস্কের পরিবারবিষয়ক মন্ত্রী ফাতেমা বেতুল সায়ান কায়াকে যেদিন নেদারল্যান্ডস থেকে বের করে দেওয়া হলো, সেদিন তিনি সত্যিই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। জার্মানির ডুসেলডর্ফ থেকে সড়কযোগে নেদারল্যান্ডসের রটারডামের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন মন্ত্রী কায়া, উদ্দেশ্য ছিল নেদারল্যান্ডসপ্রবাসী তুরস্কের নাগরিকদের সামনে নিজ দেশের কনস্যুলেট ভবনে তুরস্কের আসন্ন গণভোটের পক্ষে প্রচারণা সভা করবেন। রটারডাম থেকে পুলিশের গাড়ি মন্ত্রীকে এসকর্ট করে আবার জার্মানি সীমান্তে পুশব্যাক করল। নেদারল্যান্ডস সরকার অবশ্য আগে থেকেই এ ধরনের সভা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও মন্ত্রী কায়া তা আমলে নেননি। এর আগে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসগলুকে বহনকারী উড়োজাহাজকে নেদারল্যান্ডসে অবতরণ করতে দেশটির সরকার বাধা দেয়।
এ দুটি ঘটনায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নেদারল্যান্ডসের সরকারকে অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট বলে আখ্যা দেন। তিনি নেদারল্যান্ডস সরকারের এ আচরণকে নাৎসিদের আচরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর আগে তিনি জার্মানিকে একই ধরনের আখ্যা দেন। নিজের ক্ষমতাকে আরও নিরঙ্কুশ ও কুক্ষিগত করতে ক্রমেই নিজ দেশের ভিন্নমতাবলম্বী, প্রতিবেশী ও পশ্চিমের দেশগুলোর প্রতি লাগামহীন শিষ্টাচারবহির্ভূত কথাবার্তা বলছেন তিনি।
তুরস্কের সংবিধানে একাধিক পরিবর্তন এবং এরদোয়ানের হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়ার লক্ষ্যে আগামী ১৬ এপ্রিল গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত তুরস্কের নাগরিকদের কাছ থেকে ভোট নেওয়ার লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীদের সে দেশগুলোতে উপর্যুপরি নির্বাচনী প্রচারসভা অনুষ্ঠান বাতিল করা নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে ইউরোপের নানা দেশের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।
সপ্তাহ দুয়েক আগে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ইয়েলড্রিম জার্মানির ওবারহাউজেনে এ ধরনের একটি নির্বাচনী সভা করার পর থেকে গাগেনাউ শহরে তুরস্কের আইনমন্ত্রী বেকির, কোলন শহরে পরিকল্পনামন্ত্রী জেবেকসির বোজডাগেসের এবং হামবুর্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট কেভেসগুলুর এ ধরনের নির্বাচনী প্রচারসভা স্থানীয় প্রশাসন বাতিল করে দেয়। এসব ঘটনায় আঙ্কারায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূতকে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল। মন্ত্রী কায়াকে বহিষ্কার করার পর এবার আঙ্কারায় নেদারল্যান্ডসের দূতাবাস পুলিশ ঘেরাও দিয়ে রেখেছে।
এর আগে জার্মানির রাজধানী বার্লিন থেকে প্রকাশিত ডের ভেল্ট পত্রিকার সাংবাদিক ডেনিজ ইউসেলকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তুরস্কে গ্রেপ্তারের ঘটনায় জার্মান সরকার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। জার্মানি-তুরস্ক যৌথ নাগরিকত্বের অধিকারী সাংবাদিক ডেনিজ ইউসেলকে গ্রেপ্তারে জার্মানিজুড়ে সাংবাদিকেরা বিক্ষোভ দেখান। মূলত কুর্দি জাতিসত্তার ওপর নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশের কারণে সাংবাদিক ডেনিজ ইউসেলকে তুরস্কে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সাংবাদিক ডেনিজ ইউসেলকে জার্মানির এজেন্ট ও কুর্দি জাতিসত্তার সক্রিয় কর্মী বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

>তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বিষয়টিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একধরনের শঠতা ও ভণ্ডামি বলে উল্লেখ করে এ ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশেই মানবাধিকারের চর্চা নেই বলে উল্লেখ করেছেন

জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, জার্মানির মাটিতে তুরস্কের নির্বাচনী সভার সিদ্ধান্তের এখতিয়ার স্থানীয় প্রশাসনের আওতায়, এ ক্ষেত্রে তাঁর কিছু করার নেই। আর নাৎসিদের সঙ্গে তুলনা প্রসঙ্গে ম্যার্কেল বলেছেন, এই বক্তব্য একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুট বলেছেন, তুরস্কের সরকার কূটনৈতিক সম্পর্কের সীমানা লঙ্ঘন করছে। স্বৈরতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়া এরদোয়ানের এ ধরনের আচরণ নিয়ে জার্মানির সব রাজনৈতিক দলই তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং জার্মানির নাৎসি জমানার নিপীড়ন–নির্যাতন সম্পকে৴ তাঁর যথেষ্ট ধারণা নেই বলে মনে করছে।
যাঁদের নিজ দেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই, তাদের অগণতান্ত্রিক শাসনকে পাকাপোক্ত করতে অপর গণতান্ত্রিক দেশে গিয়ে গণভোটের জন্য প্রচারসভা করার চেষ্টা একধরনের শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ। জার্মানি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে অন্য একটি দেশে নিজেদের স্বৈরাচারী রাজনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীদের সভা করতে দেওয়া কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে ইউরোপে নানা আলোচনা হচ্ছে।
প্রায় ৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১৮ শতাংশই বা প্রায় ২ কোটি কুর্দি জাতিসত্তার বাস তুরস্কে। ১৯৮৪ সাল থেকেই তুরস্কের সরকারগুলোর সঙ্গে কুর্দি জাতিসত্তার জনপ্রিয় দল কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির সশস্ত্র গেরিলাদের হামলা-পাল্টা হামলাতে উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। এখন অবশ্য কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি তুরস্কে একটি নিষিদ্ধঘোষিত দল।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৭০ জন সদস্য গত বছরের ১৭ মে এক বিবৃতিতে বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করার জন্য সংবিধান পরিবর্তনের এই প্রচেষ্টাকে তুরস্কে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তখন থেকেই শুরু হয়েছে ইউরোপের নানা দেশের সঙ্গে তুরস্কের তীব্র কূটনৈতিক তিক্ততা।
গত বছরের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থান হওয়ার পর থেকেই তুরস্কের বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান, বিরোধী সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া এবং সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে। তুরস্ক দীর্ঘদিন থেকে ন্যাটো জোটের সদস্য এবং বেশ আগে থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। তুরস্কে আগত সিরীয় শরণার্থী ও মানব পাচারকারীদের রুখতে গত বছর তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তিপত্রে শরণার্থী পুনর্বাসন ও মানব পাচারকারীদের ঠেকাতে ছয় হাজার মিলিয়ন ইউরো অর্থসাহায্য ছাড়াও তুরস্কের নাগরিকদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আগমনের ক্ষেত্রে ভিসা প্রথা বাতিলের কথা বলা হয়।
তুরস্কের সঙ্গে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে করা চুক্তির বিষয়গুলো নিয়েও তিক্ততা বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, চুক্তির সময় তুরস্কে যে সন্ত্রাস প্রতিরোধবিষয়ক আইন আছে, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ করার কথা বলা হয়েছিল, যা তুরস্কের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল মানছে না। এ ছাড়া চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নে তুরস্ককে উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না, এ জন্য বিনা ভিসায় গত বছরের জুন মাস থেকে সে দেশের নাগরিকদের ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আসার বিষয়টি সুরাহা হচ্ছে না।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বিষয়টিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একধরনের শঠতা ও ভণ্ডামি বলে উল্লেখ করে এ ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশেই মানবাধিকারের চর্চা নেই বলে উল্লেখ করেছেন।
সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতিতে তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনেক আগে থেকেই নানা ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করলেও সম্প্রতি শরণার্থী বিষয়কে পুঁজি, বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং দেশটিতে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে করে মোস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্কের আধুনিক তুরস্ক শুধুই পেছাবে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি।
[email protected]