তুড়ি মেরে ধনী হব, কে ঠেকাবে

আশির দশকে লাখো যুবকের মর্মবাণী হয়ে উঠেছিল আমজাদ হোসেনের নাটকের এই সংলাপ, ‘দুবাই যামু, ট্যাকা দেন’। অনেক আদম ব্যবসায়ী সে সময় গ্রামের যুবকদের টাকা মেরে বড়লোক হয়ে যান। নব্বইয়ের দশকে মুখে মুখে ফিরত শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ নাটকের বুলি, ‘টাকাই মাটি, মাটিই টাকা…জমি আমার চাইই’। এখনকারটা রৌপ্য হলে সেটা ছিল ভূমিদস্যুদের স্বর্ণযুগ। কৃষক ও প্রকৃতির মাটি কেড়ে নিয়ে তাঁদের কেউ কেউ প্রথমে ডেভেলপার, পরে শিল্পপতি এবং কেউ কেউ এমনকি এমপি-মন্ত্রীও হন। এখনকার সময়টা ‘আয়নাবাজির’। নকল কোম্পানি বানিয়ে একজনের অপরাধে আরেকজনকে ফাঁসিয়ে কিংবা একজনকে বিলিয়নিয়ার বানাতে লাখো মানুষকে পথে বসানোর এই খেলাই চলছে হরদম হরদম।

এখনকার সত্যটা কমেডি করে নাট্যকারদের বলতে হয় না, ভুক্তভোগীদের ট্র্যাজিক আহাজারি থেকেই সবাই তা জানতে পারে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েই যেমন কান্নার মধ্য দিয়ে আগমনবার্তার জানান দেয়, ইভ্যালি কিংবা ই-অরেঞ্জের মতো কোম্পানি চালু হওয়ামাত্রই অজস্র মানুষের ঠকামির মধ্য দিয়ে রটে যায়, দেশে আরও কিছু কোটিপতির জন্ম হয়েছে। গত ছয় বছরে বিভিন্ন রকম ব্যবসার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কয়েকটি ফটকা কোম্পানির কিছু মালিক (প্রথম আলো, ১৯ সেপ্টেম্বর)। এরা সবাই তুড়ি মেরে ধনী হতে চেয়েছেন। এই ‘তুড়ি মেরে ধনী হওয়া’ই হাল আমলের বাংলাদেশের নতুন প্যারাডক্স বা ধাঁধা।

বিশ্বের তাবড় তাবড় সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদের কাছে একসময় বাংলাদেশের উন্নতিকে ধাঁধা বলে মনে হয়েছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুঃশাসন ও দুর্নীতিতে সয়লাব হয়েও কীভাবে দেশটা দারিদ্র্য ঘোচাচ্ছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিক্ষিত করছে, নারীদের নিয়ে আনছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার সিঁড়িতে? এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সরলভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে, যেদিন থেকে এ দেশের মানুষ অল্পে তুষ্ট হওয়া বন্ধ করেছে, সেদিন থেকে তারা প্রথমে দেশের স্বাধীনতা, তারপর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সোনার হরিণের পেছনে ছুটে চলেছে। ডলার কামানোর নেশায় কৃষকের সন্তানসন্ততিরা লাখে লাখে প্রবাসী হয়েছেন। নিজেদের শিরদাঁড়া ক্ষয় করে তাঁরা জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড শক্ত করেছেন।

কথিত ‘অবলা’ নারীরা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে পোশাক কারখানার মালিকদের হাতে আলাদিনের চেরাগ তুলে দিয়েছেন। এই চেরাগের জ্বালানি কখনো ফুরায় না, আবার এর দামও অতি সস্তা। গ্রামের গরিবদের সস্তা শ্রম এভাবে দেশে ও বিদেশে সুলভ মূল্যে বিক্রি হয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়িয়েছে। তারা শুধু নিজেকে নয়, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের জন্যও প্রতিষ্ঠার রাস্তা খুলে দিয়েছে। এই দেশের কৃষকেরা হাজারো বাধা নিয়েও প্রতিবছর মাটি থেকে আশ্চর্য রকম শস্য ও ফলফলাদি ফলান। এই দেশের মানুষ পিঁপড়ার মতো শরীরের চাইতে অনেক গুণ বেশি ওজন বইতে পারে, একজন আয় করে দশজনকে টেনে তোলেন। এই উদ্যম, এই অক্লান্ত প্রচেষ্টাই বাংলাদেশ প্যারাডক্সের সহজ উত্তর।

গত দুই দশকে দুর্নীতি, প্রতারণা, ব্যাংক লোপাট, সড়ক-সেতুতে বাঁশ-দেওয়া উন্নয়ন বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশ প্যারাডক্সকে। কালা টাকা ধলা মুখ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাতারাতি ধনী হওয়ার তাড়না যে কতজনকে পোড়াচ্ছে!

পশ্চিম বাংলার সদ্য প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের বাংলাদেশ নিয়ে লেখালেখির একটা বই প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। নাম ‘সন্ধ্যা নদীর জলে বাংলাদেশ’। বইটার একটা অধ্যায়ের অনেকগুলো লেখাতেই বাংলাদেশ নিয়ে নিখাদ বিস্ময় ঝরে ঝরে পড়েছে। প্রথম আলোরই সংবাদ থেকে তিনি জেনেছেন, বুয়েটপড়ুয়া এক ছাত্র কীভাবে চলনবিল এলাকায় নৌকাস্কুলের ধারণার জয় ঘটিয়েছে। নৌকায় বানানো স্কুল, লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, কৃষি প্রশিক্ষণকেন্দ্র চলে আসছে গ্রামের ঘাটে ঘাটে। ২০০৬ সালেই ৪৩৭টি গ্রামে চলছিল এই প্রকল্পের কাজ। এ রকম অজস্র নিঃস্বার্থ সামাজিক উদ্যোগও ছিল দেশটার প্রাণভোমরা। এই শ্রম, এই সামাজিক পুঁজি আর উন্নত জীবনের স্বপ্ন বাংলাদেশকে বদলে দিচ্ছিল।

কিন্তু গত দুই দশকে দুর্নীতি, প্রতারণা, ব্যাংক লোপাট, সড়ক-সেতুতে বাঁশ-দেওয়া উন্নয়ন বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশ প্যারাডক্সকে। কালা টাকা ধলা মুখ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাতারাতি ধনী হওয়ার তাড়না যে কতজনকে পোড়াচ্ছে! সময়ের এই সত্য প্রকাশ করেছেন কোনো বড় সাহিত্যিক বা চলচ্চিত্রকার নন, টেকনাফের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পিয়ন আবদুর রহিম। ২০ হাজার ইয়াবাসহ ধরা পড়ার পর পুলিশকে তিনি বলেছেন, ‘চোখের সামনে রিকশাওয়ালা, ড্রাইভার, লেবারসহ অনেকে ইয়াবার কারবার করে বড়লোক হয়ে গেল, আমি হব না কেন?’ তুড়ি মেরে ধনী হওয়াই এখনকার নেশা। ইয়াবার কারবারি থেকে ইভ্যালির রাসেল কিংবা ভারতে আটক পুলিশের এসআইই সোহেল রানারা তুড়ি মেরেই ধনী হতে চেয়েছেন। ধরা পড়াটা ‘দুর্ঘটনা’ বৈকি। অনেক রাসেল কিংবা সোহেল রানা হয় বিদেশে সম্পত্তি ভোগ করছেন কিংবা দেশেই তবিয়ত যারপরনাই উন্নত করে চলেছেন। জেলে যে কয়জন আছেন বটে, কিন্তু চুরি বা পাচার করা কোনো টাকাই তাঁদের কাছ থেকে বের করা যায়নি। যথাসময়ে জামিন নিয়ে তাঁরাও পগারপার হবেন। জেলে পচে মরবেন কেবল আবদুর রহিমের মতো চুনোপুঁটিরা।

সড়কে রোড সাইন বলে দেয়, কোনটা পথ আর কোনটা বিপদ। দেশেও কিছু ঘটনা রোড সাইনের মতো সামনে আসে। বলে, দেশ চলছে কোন পথে। এখানে অনেকে মনে করছে, ‘চাইলেই তো বড়লোক হওয়া যায়। অমুক হয়েছে, তমুক হয়েছে। আমি কেন বাদ পড়ব?’ ধনী হওয়ার এই উদগ্র নেশা কত পাপিয়া-সম্রাট-রাসেল-রানা তৈরি করছে, তার হিসাব নেই। দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এদের দারুণ দোস্তালি দেখা যায়। এদের পাশে দাঁড়ান নেতা, বাহিনীর কর্তা, সেলিব্রিটি নায়ক-নায়িকা কিংবা খেলোয়াড়। সবাই ভাগমতো টাকা পেয়েছেন। সেই টাকা গেছে মধ্য ও নিম্নবিত্তদের সঞ্চয় থেকে। কষ্টে জমানো টাকা বাড়ানোর আশায় তাঁরা বিনিয়োগ করেন শেয়ারবাজারে, রাখেন ব্যাংকে কিংবা তুলে দেন ফটকা কোম্পানির হাতে। মধ্যবিত্তের সঞ্চয় খেয়ে ফেলার কল সবখানেই বসানো। কিছু হলেই সরকার বলে, কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়! এটা অবিচার।

করোনাকালেও অজস্র নতুন কোটিপতি তৈরি হয়েছে। আগে বড়লোকেরা আরও বড়লোক হতো; বাকিরা চেয়ে চেয়ে দেখত। এখন গরিবদের অনেকেরও সেই বাসনা জেগেছে। তার জন্য তারা ক্ষমতার সঙ্গে দেওয়া-নেওয়া করে মাদক ব্যবসা করছে, সরকারি দপ্তরের নিচু পদে থেকে বড় পদের দুর্নীতিবাজদের নায়েবগিরি করে নিজেরাও টাকা বানাচ্ছে। যদি আপনি রাঘব বোয়ালদের গ্রাস বন্ধ না করেন, তাহলে চুনোপুঁটিদের দৌরাত্ম্যও বন্ধ হবে না। ক্রিমিনাল অর্থনীতিতে তারা দুজন-দুজনার। দুর্নীতি-পাচার-দায়মুক্তির এই বিষাক্ত চক্র বাংলাদেশ প্যারাডক্সকে আত্মঘাতী করে তুলছে। আজ হোক, কাল হোক, চাক ভেঙে মধু খাওয়া ভালুকদের থামাতেই হবে।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]