শহীদ কাদরীর আবির্ভাব ছিল দাপুটে। কবিতায়, আড্ডায়, বাউণ্ডুলেপনায়, ঠাট্টায়। ১৯৫০-এর দশকের ঢাকা শহর তখন আড়মোড়া ভেঙে জাগতে শুরু করেছে। তার মধ্যে জেগে উঠছে ভবিষ্যতের এক স্বাধীন দেশের রাজধানী হওয়ার তৃষ্ণা। আর তাতে ইন্ধন দিচ্ছেন সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া বেপরোয়া কিছু কবি ও শিল্পী। কিশোর শহীদ কাদরী ভিড়ে গেলেন এই দলে। শুধু ভিড়লেন না, হয়ে উঠলেন আড্ডার মধ্যমণি। উন্মাতাল ঝোড়ো হাওয়ার মতো তাঁর উপস্থিতি মাতিয়ে দিল ঢাকার নানা গলি, রেস্তোরাঁ আর বইয়ের দোকান।
শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক ও আল মাহমুদের যে কবিদলের সঙ্গে এক নিশ্বাসে আসে শহীদ কাদরীর নাম, সেখানে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট। শামসুর রাহমানের চেয়ে সাক্ষাৎ ১৩ বছরের ছোট। কিন্তু তাঁর নিজের বয়স যখন ১৪, তখনই তাঁর কবিতা অনুমোদন পেয়ে গেছে বুদ্ধদেব বসুর। বুদ্ধদেব বসু তখন আধুনিক বাংলা কবিতার বিধাতাপ্রায়। তাঁরই অভিজাত সাহিত্যপত্র কবিতায় বেরিয়ে গেল কিশোর শহীদ কাদরীর লেখা।
তরুণ শহীদ কাদরীর চালচুলোহীন বাউণ্ডুলে জীবন হয়ে উঠেছিল কিংবদন্তিপ্রতিম। এই উন্মূল ছন্নছাড়া নগর-জীবনের ছবি তাঁর কবিতাকেও অনন্য করে তুলেছিল। কবিতায় তিনি ছিলেন অকপট, নিজেকে প্রকাশ করার ব্যাপারে একেবারে খোলামেলা।
এসব অনন্যতা সত্ত্বেও শহীদ কাদরী বেশি লেখেননি। ১৯৬৭ সালে বেরোয় তাঁর প্রথম কবিতার বই উত্তরাধিকার। প্রথম বই দিয়েই বাজিমাত। এরপর আর দুটো মাত্র কাব্যগ্রন্থ তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ও কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। এরপর তাঁর লেখা প্রায় থেমে যায়। তিনি চিরকালের জন্য পাড়ি জমান বিদেশে। মৃত্যুর কিছুকাল আগে আবার লেখালেখিতে সচল হতে শুরু করেছিলেন।
শহীদ কাদরী যে বেশ শখ করে বিদেশে গিয়েছিলেন, তা নয়। গিয়েছিলেন হতাশা নিয়ে। কাছের কিছু মানুষের কাছ থেকে প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে। তবে সে তিক্ততা তাঁর মনে চিরস্থায়ী দাগ ফেলেনি। নানা দেশে ঘোরাঘুরি করে শহীদ কাদরী শেষমেশ থিতু হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশ থেকে কেউ গেলে আন্তরিকভাবে তাঁকে বরণ করতেন।
নিউইয়র্কে শহীদ কাদরীর বাড়িতে তাঁর উষ্ণ আতিথ্যের কথা বারবার মনে পড়ছে। তখনো তাঁর কঠিন অসুখ। যকৃতের নিয়মিত ডায়ালিসিস করতে হয়। আহার-নিদ্রা চলে কঠোর শৃঙ্খলায়, স্ত্রী নীরা কাদরীর মমতাময় শাসনে। তবু তার মধ্যেও তাঁর ক্লান্তি নেই। তিনি আমাদের ছাড়েন না। তাঁর বিখ্যাত সেই আড্ডা চলল মধ্যরাত পর্যন্ত। আর সেই আড্ডায় ফিরে ফিরে আসতে থাকল দুটিই মাত্র প্রসঙ্গ: বাংলাদেশ আর কবিতা। আর সব ছাপিয়ে ঘরে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল তাঁর প্রাণখোলা হাসি। মনের গভীরে তিনি জানতেন, আর কখনো তাঁর বাংলাদেশে ফেরা হবে না। কিন্তু বারবার বললেন, ‘দেশে আমি একবারের জন্য হলেও যাব।’
প্রবাস-জীবনের দীর্ঘ নীরবতার পর বেরিয়েছিল শহীদ কাদরীর শেষ কবিতার বই আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দিও। এরপর তাঁর কলম আর রুদ্ধ হয়নি। ধীরে চলছিল, কিন্তু সচল ছিল। নতুন বইয়ের কথাও হয়তো ভাবছিলেন। মৃত্যু তাতে যতি টেনে দিল।
শহীদ কাদরী বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন একুশে পদক। কবির জন্য তো এসব বাহ্য সম্মান। পাঠকদের ভালোবাসা পেয়েছেন বুকভরা। আর, একটি অনন্য আসন তো তাঁর থেকেই যাবে চিরকাল। বাংলাদেশের কবিতার প্রতিষ্ঠাতা প্রজন্মের তিনিও তো একজন। এ জন্য চিরকাল তিনি অভিবাদন পেয়ে যাবেন ভবিষ্যৎ বাংলা কবিতার।
তোমাকে অভিবাদন, কবি!
আরও পড়ুন