দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে চ্যালেঞ্জও বাস্তবতা

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে আজ যে গতি লক্ষ করা যাচ্ছে, তা বর্তমান সরকারের নিরলস পরিশ্রমের ফসল। সীমিত জ্বালানিসম্পদ দিয়ে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের চাহিদার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি) ২০১০ অনুযায়ী সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা তথা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সুষম জ্বালানি নীতি অনুসরণ করছে। এ লক্ষ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জ্বালানি গ্যাস ও তেলের স্বল্পতার কারণে এর ব্যবহার কমিয়ে কয়লার ব্যবহার বাড়ানো, এলএনজি ও পারমাণবিক জ্বালানির ব্যবহার সংযোজনকরণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার শক্তিশালীকরণ করতে চায় সরকার।

অন্যদিকে দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানিনিরাপত্তার স্বার্থে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিনিয়োগও করছে সরকার। আবার গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উৎকর্ষ সাধন, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামক দুটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের দক্ষতা, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে গ্রাহকসেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নতুন নতুন আইন, নীতিমালা ও বিধিবিধান তৈরি করছে সরকার। এত সব কর্মযজ্ঞ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেতে হলে সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে।

এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী গত ২৩ সেপ্টেম্বর এবং অন্য একদিন এক টিভি আলোচনায় বলেছেন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার প্রকৌশলী প্রয়োজন এবং দেশে কোনো পেট্রোলিয়াম কিংবা মাইনিং প্রকৌশলী নেই। তিনি আরও বলেছেন, বুয়েটের কিছু প্রকৌশলী এ খাতে প্রবেশ করার পর চার-পাঁচ বছর বাস্তবসম্মত জ্ঞান অর্জনের পর যখন দক্ষ হয়ে ওঠেন, তখন তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানে না থেকে বিদেশে চলে যান। তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে দক্ষ ও মেধাবী প্রকৌশলীদের অভাবে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এবার আসা যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে এ খাতে চাকরির সুযোগ পেতে পারেন এমন নবাগত প্রকৌশলীদের তথ্যচিত্রে। আমার জানা মতে, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বছরে আনুমানিক ১৩ হাজার প্রকৌশলী তৈরি করছে। এর মধ্যে এ খাতসংশ্লিষ্ট তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশলে ১ হাজার ৫০০, যন্ত্রকৌশলে ৬০০, কেমিকৌশলে ৩০০ এবং পেট্রোলিয়াম, খনিজ সম্পদকৌশলে ৯০ জনসহ আনুমানিক ২ হাজার ৫০০ নবাগত প্রকৌশলী বের হচ্ছেন। এর মধ্যে শিক্ষকতা পেশায় ১০ ভাগ এবং বিদেশে চলে যাওয়া ৩০ ভাগ ধরলে বাকি থাকে ১ হাজার ৫০০। এ ১ হাজার ৫০০ জন প্রকৌশলীর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে কতটুকু চাহিদা রয়েছে, তা নিরূপণ করা দরকার।

আমার ধারণা থেকে বলতে পারি, ১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন থার্মাল/পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রায় ৪০০ প্রকৌশলী প্রয়োজন। এ পর্যন্ত পারমাণবিক ২টিসহ সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন, ১৮টি টেন্ডারিং পর্যায়ে এবং ৬টি পরিকল্পনাধীন রয়েছে। বছরে যদি গড়ে একটি ১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে হয়, তাহলে প্রয়োজন ৪০০ প্রকৌশলীর। তা ছাড়া রয়েছে ১০১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়। আরও রয়েছে পেট্রোবাংলার অধীন ১৩টি প্রতিষ্ঠান, যারা তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আহরণ, সঞ্চালন ও বিতরণে নিয়োজিত। তাদেরও বেশ চাহিদা রয়েছে দক্ষ মানবসম্পদের। অন্যান্য গবেষণা ও বেসরকারি সংস্থার চাহিদার কথা তো বাদই রইল। কাজেই সংকট যেহেতু আছেই, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় আসনসংখ্যা বাড়ানো, মানসম্মত শিক্ষাদানের জন্য ভৌত অবকাঠামোসহ উন্নত ল্যাবরেটরি নির্মাণের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন নয় কি?

সরকার অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বর্তমানে যে বেতন-ভাতা প্রদান করছে, তা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। আর বিদ্যুৎ খাতে বিরাজমান কোম্পানিগুলোতে বেতন-ভাতা তো কয়েক গুণ বেশি। তাহলে মেধাবী ও দক্ষ প্রকৌশলীরা এ খাতে স্থায়ী ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে আগ্রহী নন কেন? কিসের অভাবে দক্ষ ও মেধাবী প্রকৌশলীরা সম্ভাবনাময় ও অত্যন্ত আকর্ষণীয় এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন? ব্যাপারটা নিয়ে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করা দরকার নয় কি? সরকার সংস্কার কর্মসূচির আওতায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের উৎপাদন ও বিতরণ কার্যক্রমকে ভেঙে আলাদা আলাদা উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানি তৈরি করছে। বলা হচ্ছে, আর্থিকভাবে সচ্ছলতা আনতে উৎপাদন ও বিতরণ খাতে বেসরকারি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বিদ্যুৎ খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, গ্রাহকসেবা বৃদ্ধি, জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।

তবে এ সংস্কার কর্মসূচির সুযোগে নবগঠিত উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদে ঢুকছেন অপেশাদার কর্মকর্তারা। বর্তমানে উচ্চ বেতন-ভাতার কারণে প্রকৌশলীদের বিদেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। তবে বেতন-ভাতা যতই দেওয়া হোক না কেন, ন্যূনতম জব সেটিসফেকশন বলতে একটা কথা আছে। আজ এ খাতে অপেশাদার কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ তরুণ মেধাবীরা কীভাবে দেখছেন, তা বিবেচনায় আনা অত্যন্ত দরকার। ধরা যাক, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির গঠিত নয় সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের কথা। এখানে পেশাদার ও অপেশাদার কর্মকর্তাদের অনুপাত হচ্ছে ৩: ৬। তাহলে বিষয়টি সহজেই অনুমেয়, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ পেশাদার প্রকৌশলীদের কতটুকু মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তরুণ মেধাবীদের এ খাতে ধরে রাখতে ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ কী কী করছে, তা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি।

বিদ্যুৎ খাত সম্প্রসারণ ও জ্বালানি বহুমুখীকরণের জন্য জনবল বৃদ্ধি ও দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা আজ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলেও দক্ষ জনবল সৃষ্টির জন্য নিজস্ব প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত গড়ে তোলেনি। সরকার এ খাতে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি জোরদারের জন্য ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। নিচে প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনা করলে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কিছুটা সহায়ক হতে পারে।

১. সরকার জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতকে যেভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, এ-সংক্রান্ত শিক্ষা ও গবেষণা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

২. মেধাবী প্রকৌশলীদের নিয়োগ, যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁদের সঠিক সময়ে পদোন্নতি দেওয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের বসানো এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া।

৩. জীবাশ্ম ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক শতাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা, গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ পাওয়ার সেক্টর ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা। এ খাতে কর্মরত সব প্রকৌশলীর দক্ষতা বাড়াতে প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে অভিজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ও গবেষকদের এই প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া।

৪. সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এনার্জি সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে কোর্স প্রবর্তন করা। যার উদ্দেশ্য হবে এনার্জি পলিসি, এনার্জি প্ল্যানিং, এনার্জি ফাইন্যান্সিং, এনার্জি অনুসন্ধান, এনার্জি ডিপ্লোমেসি, এনার্জি ট্রেডিং, এনার্জি কনভার্সন, কনজারভেশন, এনার্জি ম্যানেজমেন্ট, সাশ্রয়ীভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ, এনার্জি ইফিসিয়েন্সি, এনার্জি অডিট, এনার্জি কালচার, এনার্জি সেভিংস ইত্যাদি বিষয়ে বুৎপত্তিগত শিক্ষাদান।

সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগবে না। নিশ্চিত হবে ঘরে ঘরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়